বান্দরবানে কিছু মানুষ শিক্ষার প্রসারে কাজ করছেন। ছয় শতাধিক মানুষ একটি সমিতি গড়েছেন। নাম দিয়েছেন ক্রংসের ব্যাংকভু। বাংলায় যার অর্থ— মাটির ব্যাংক সমিতি। সমিতির সদস্যরা সবাই ক্রামা ধর্মের পুরোহিত ও সেবক। তারা প্রত্যেকেই ঘরে মাটির ব্যাংক রাখেন। যখন যতটুকু সম্ভব, সেখানে টাকা জমান। উদ্দেশ্য সমাজের জন্য, বিশেষ করে শিক্ষার জন্য কিছু করা।
কেউ তারা বাংলায় পড়তে-লিখতে জানেন না। অথচ শিক্ষা নিয়ে তাদের আগ্রহের শেষ নেই। দুর্গম এলাকার শিশুরা পড়ালেখা শিখে বড় হোক, এমন চিন্তা থেকে প্রতিষ্ঠা করেছেন একটি ছাত্রাবাস ও একটি ছাত্রীনিবাস। তা-ও আবার ১০ বছর ধরে মাটির ব্যাংকে জমানো টাকায়।
এই ছাত্রাবাস ও ছাত্রীনিবাস অবস্থিত বান্দরবান সদর উপজেলার টঙ্কাবতী ইউনিয়নের চাক্কোইপাড়া এলাকার ব্রিকফিল্ড বাজার সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের পাশে। নাম রাখা হয়েছে ‘আরোং আনৈই’। বাংলায় এর অর্থ— অগ্রগতির আলো। ছাত্রাবাসটিতে ৫০ জন এবং ছাত্রীনিবাসে ২০ জন ম্রো শিশু রয়েছে। তারা সবাই সেখানে থেকেই পড়ছে পাশের ব্রিকফিল্ড বাজার সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে।
যে সমিতির সদস্যদের উদ্যোগে আরোং আনৈই প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে, এর নাম— চলতি জানুয়ারি মাসের শুরু থেকেই আরোং আনৈই-এ থেকে ৭০ শিশু পড়ালেখা করছে। যদিও এর উদ্বোধন করা হয়েছে গত রবিবার। উদ্বোধন করেন টঙ্কাবতী ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মাংয়ং ম্রো। বিশেষ অতিথি ছিলেন ম্রো ভাষার লেখক ও গবেষক ইয়াংঙান ম্রো, দক্ষিণ হাঙর মৌজার হেডম্যান (মৌজাপ্রধান) পারিং ম্রো। উপস্থিত ছিলেন টঙ্কাবতী ইউনিয়ন পরিষদের সদস্য মেনতাং ম্রো, য়ংঙি ম্রো। সভাপতিত্ব করেন ক্রংসের ব্যাংভু’র সভাপতি সিংলক ম্রো। অনুষ্ঠানে আরো অংশগ্রহণ করেন আরোং আনৈই-এ থাকা শিক্ষার্থীদের অভিভাবকেরা।
ক্রংসের ব্যাংকভুর সভাপতি ও ক্রামা ধর্মের পুরোহিত সিংলক ম্রো নিজেও বাংলা বলতে পারেন না। ম্রো ভাষায় তিনি জানান, ১০ বছর ধরে জমিয়ে প্রায় ২০ লাখ টাকা হয়েছে তাদের। সমিতির সর্বশেষ সভায় ম্রো শিশুদের বাংলা ও মাতৃভাষা ম্রোতে পড়াশোনা করানোর জন্য ছাত্রাবাস ও ছাত্রীনিবাস করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল। এরই অংশ হিসেবে আরোং আনৈই প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। এ প্রতিষ্ঠানে শিশুদের নিজেদের ক্রামা ধর্ম, মাতৃভাষা ও বাংলা শিক্ষার ব্যবস্থা থাকবে। বাংলায় শিক্ষিত ম্রোরা যদি নিজেদের মাতৃভাষা না জানেন তবে ম্রো ভাষা হারিয়ে যাবে। তিনি আরো বলেন, আমাদের প্রতিষ্ঠানটি টিকিয়ে রাখতে সরকারি-বেসরকারি সহযোগিতা দরকার। না হলে দীর্ঘ সময় ধরে পরিচালনা কঠিন হতে পারে।
ম্রো ঐতিহ্যবাহী স্থাপত্যে খুঁটির উপর মাচাং দিয়ে আরোং আনৈই নির্মাণ করা হয়েছে। চারপাশে বাঁশের নিখুঁত বেড়া, উপরে টিনের ছাউনি। সামনে রয়েছে খোলা বারান্দা। বারান্দায় দাঁড়িয়ে শিক্ষার্থীরা খোলা হাওয়া উপভোগ করতে পারে। ভেতরে একটি কক্ষে সবাই পড়াশোনা করে ও বিছানা পেতে ঘুমায়। শিক্ষার্থীরা মিয়ানমার সীমান্তবর্তী থানচির লেইক্রী, বড় মদক; আলীকদমের কুরুকপাতা ও রুমার নাইতিংয়ে দুর্গম এলাকার।
নিজের শিশুসন্তানকে আরোং আনৈই-এ রেখেছেন থানচি উপজেলার লেইক্রীর মেনসাই ম্রো। তিনি বলেন, উপজেলা সদর থেকে প্রায় ১০০ কিলোমিটার দূরে লেইক্রী এলাকা। সেখানে কোনো বিদ্যালয় নেই। সাঙ্গু নদের উজানে নৌকায় চলাচল ছাড়া যোগাযোগের ব্যবস্থা নেই। বর্ষায় বেশি পানি হলে কিংবা শুষ্ক মৌসুমে পানি শুকিয়ে গেলে নৌকায়ও চলাচল করা যায় না। এমন অবস্থায় আরোং আনৈই ছাত্রাবাসে ছেলেকে রাখতে পেরে তিনি খুবই খুশি।
ক্রংসের ব্যাংভু সমিতির সদস্য রিংয়ং ম্রো বলেন, আরোং আনৈই’র শিক্ষার্থীরা দিনে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে বাংলা ও ইংরেজি ভাষায় এবং ছাত্রাবাসে বাংলা ও মাতৃভাষায় পড়াশোনা করবে। ম্রো ভাষার আবাসিক শিক্ষকেরা মাতৃভাষায় পাঠদান করবেন। তিনি বলেন, সমিতির সিদ্ধান্ত হলো কেবল দুর্গম এবং বিদ্যালয় নেই, এমন এলাকার শিশুদের ছাত্রাবাস ও ছাত্রীনিবাসে রাখা হবে, যাতে তারা শিক্ষাবঞ্চিত না হয়। সরকারি শিশু পরিবার, আবাসিক বিদ্যালয়, অনাথাশ্রমে সুযোগ পাওয়া শিশুদেরও ভর্তি না নেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়েছে।
আরোং আনৈই’র আবাসিক শিক্ষক থংয়া ম্রো বলেন, ছাত্রাবাসে দুজন ম্রো ভাষার ও দুজন বাংলার শিক্ষক রয়েছেন। শিক্ষার্থীদের খাওয়াদাওয়া, রান্নাসহ প্রয়োজনীয় কাজের জন্য রয়েছেন দুজন কর্মচারী। খরচ হিসেবে অভিভাবকেরা বছরে ১২ হাজার টাকা করে দেবেন। এই টাকায় সংকুলান না হলে এবং দরিদ্র কোনো অভিভাবক টাকা দিতে অপারগ হলে ক্রংসের ব্যাংভু খরচ বহন করবে।
ব্রিকফিল্ড বাজার পাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক তন্বী দাশ বলেন, ৭০ জন শিক্ষার্থী পেয়ে শিক্ষকেরা খুবই খুশি। আরোং আনৈই’র ব্যবস্থাপনাও খুব ভালো। দুর্গম এলাকার শিক্ষার্থী বাংলা জানে না। ভাষাগত কিছু সমস্যা হলেও শিশুদের শেখার আগ্রহ দেখে শিক্ষকেরাও পাঠদানে আন্তরিক। প্রয়োজনে ম্রো শিক্ষকদের সহযোগিতা নেওয়া হচ্ছে।
ম্রো ভাষার লেখক ও গবেষক ইয়াংঙান ম্রো বলেন, চিম্বুক পাহাড়ের মেনলে নামে এক ম্রো তরুণ ১৯৮০-এর দশকে ক্রামাধর্ম প্রবর্তন করেন। ম্রো বর্ণমালাও উদ্ভাবন করেছিলেন তিনি। তখন থেকে পার্বত্য চট্টগ্রামে বসবাসরত সাড়ে ৫১ হাজার ম্রোর মধ্যে ৬০ শতাংশের বেশি ক্রামাধর্মাবলম্বী।
আমারবাঙলা/এমআরইউ