নারকেলের ছোবড়া ফেলে দেন অনেকে। আবার কেউ কেউ জ্বালানি হিসেবে ব্যবহার করেন তা। এই ছোবড়া যে ফেলনা নয়; বিষয়টি মাথায় আসেনি অনেকের।
এই ছোবড়াই লক্ষ্মীপুর জেলার অর্থনীতির চিত্র বদলে দিচ্ছে। জেলায় ছোবড়া পণ্যের ৩০টির মতো কারখানায় বছরে কোটি টাকার ব্যবসা হয়। গদি, সোফা, দড়ি, কৃষিপণ্যসহ নানা জিনিস তৈরি হয় ছোবড়া থেকে। এসব পণ্য রপ্তানি হচ্ছে বিদেশেও।
লক্ষ্মীপুর কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক সোহেল মো. শামসুদ্দীন ফিরোজ জানান, জেলায় দুই হাজার ৭৩৫ হেক্টর জমিতে নারকেলের বাগান রয়েছে। এ ছাড়া প্রতিটি বাড়ির আঙিনায় রয়েছে নারকেলগাছ। গত এক বছরে শুকনা নারকেল ও ডাব মিলিয়ে প্রায় ৪০০ কোটি টাকা আয় হয়েছে। ২০২৩-২৪ অর্থবছরে ২৬ হাজার মেট্রিক টন নারকেল উৎপাদিত হয় লক্ষ্মীপুরে।
ছোবড়ার আঁশ থেকে ঠিক কত আয় হয়, তার সঠিক পরিসংখ্যান বিসিক বা সরকারি কোনো দপ্তরেও নেই বলে জানিয়েছেন লক্ষ্মীপুর জেলা বিসিক কার্যালয়ের প্রমোশন কর্মকর্তা মো. জুয়েল চৌধুরী। তিনি বলেন, ফেলনা ছোবড়া থেকে কোটি টাকা আয় হচ্ছে। নারকেলের ছোবড়ার আঁশ ও গুঁড়া দিয়ে তৈরি বিভিন্ন পণ্য রপ্তানি হচ্ছে; আসছে বৈদেশিক মুদ্রা। এ ব্যবসার সঙ্গে জড়িতদের তালিকা তৈরির কাজ চলছে।
লক্ষ্মীপুর জেলায় নারকেলের ছোবড়া থেকে আঁশ ও গুঁড়া তৈরি হচ্ছে। নারকেলের আঁশ (ফাইবার) থেকে জাজিম, গদি, দড়ি, স্লিপার (জুতা), খেলনা ও শৌখিন সামগ্রী তৈরি হয়। ফাইবার তৈরির সময় প্রচুর গুঁড়াও উপজাত হিসেবে উৎপাদিত হয়। এসব গুঁড়া বা কোকোডাস্ট কৃষিকাজে ব্যবহৃত হয়। যেসব বাগানে মাটির অভাব রয়েছে, সেখানে এসব গুঁড়া ব্যবহৃত হয়।
ছোবড়া প্রসেসিং কারখানা গড়ে উঠেছে জেলার রায়পুর উপজেলার হায়দরগঞ্জ, সদর উপজেলার দালাল বাজার, মান্দারী, চন্দ্রগঞ্জ, রামগঞ্জ উপজেলার পানপাড়া, মীরগঞ্জ, সোনাপুর, কমলনগর উপজেলা হাজিরহাট, রামগতির আলেকজান্ডার ও জমিদারহাটে। এসব এলাকায় ছোট-বড় ৩০টি কারখানা রয়েছে। প্রতিটি কারখানায় নারী ও পুরুষ মিলে কমপক্ষে ১০-১২ জন শ্রমিক কাজ করেন।
লক্ষ্মীপুর সদর উপজেলার দালাল বাজারের একটি কারখানায় গিয়ে দেখা যায়, কারখানা চত্বরে নারকেলের ছোবড়ার স্তূপ। ডিজেলচালিত ছোবড়া কাটার যন্ত্রে ছোবড়া কেটে ছোট ছোট খণ্ড করা হচ্ছে। সেই খণ্ড হাত দিয়ে ছিঁড়ে আঁশ পৃথক করছেন কয়েকজন নারী ও পুরুষ। এই আঁশ রোদে শুকানো হচ্ছে। পরে শুকনা আঁশ পরিমাপ করে প্লাস্টিকের সুতা দিয়ে বেঁধে তৈরি করা হচ্ছে গাঁট। গাঁটকে স্থানীয়ভাবে বলা হয় ‘বেল’ (২০ কেজিতে এক বেল)। ছোবড়া থেকে আঁশ ছাড়ানোর সময় বের হওয়া গুঁড়া বস্তায় ভরে একপাশে স্তূপ করা হচ্ছে। এই ছোবড়া ও গুঁড়া দেশের বিভিন্ন স্থানে পাঠানো হয়।
কারখানার মালিক জাকির হোসেন জানান, একটি নারকেলের ছোবড়া কেনা হয় দুই থেকে তিন টাকায়। ছোবড়া থেকে পাওয়া ছয় থেকে সাত ট্রাক আঁশ দেশের বিভিন্ন স্থানে পাঠানো হয় এই কারখানা থেকে। প্রতি ট্রাক আঁশের দাম ৮০ থেকে ৯০ হাজার টাকা। ভালো দামে বিক্রি হয় ছোবড়ার গুঁড়াও। স্থানীয় নারকেল ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে তারা ছোবড়া সংগ্রহ করেন। কারখানায় আট থেকে ১০ জন শ্রমিক ছোবড়া থেকে আঁশ বের করেন।
৫০ বছর ধরে নারকেলের ব্যবসার সঙ্গে জড়িত দালাল বাজারের শশীভূষণ নাথ। ১২ বছর ধরে তিনিও ছোবড়ার ব্যবসা করছেন। তিনি জানান, নারকেলের ছোবড়ার ওপর ভিত্তি করে এক যুগ আগে জেলার দালালবাজার ও হায়দারগঞ্জে দুটি কারখানা হয়েছে। এসব কারখানার ছোবড়ার আঁশ ও গুঁড়া খুলনা, ঢাকা, কক্সবাজার, শরীয়তপুরসহ বিভিন্ন স্থানে পাঠানো হয়। সেখানে কারখানায় তোশকের (ম্যাট্রেস), জাজিম, পাপোশ, দড়ি, সোফা ও চেয়ারের গদিসহ বিভিন্ন ধরনের শৌখিন ও প্রয়োজনীয় পণ্য তৈরি করা হয়।
চারজন ছোবড়া ব্যবসায়ীর সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, লক্ষ্মীপুরের ছোবড়ার ব্যবসায়ীদের কারখানাগুলোতে বছরে গড়ে দেড় থেকে দুই কোটি টাকার ব্যবসা হয়। ৩০টি কারখানায় সেই হিসাবে কম করে হলেও অর্ধশত কোটি টাকার ব্যবসা হয়। সঠিক পরিকল্পনা নিলে নারকেলের ছোবড়া খোলকেন্দ্রিক আরো শিল্প গড়ে উঠবে।
আমারবাঙলা/এমআরইউ