এস.এম রবি, স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট
ঝিনাইদহের হরিণাকুণ্ডু উপজেলার তৈলটুপি গ্রামেই অবৈধভাবে গড়ে উঠেছে পাঁচটি ইটভাটা। এর সবগুলো লোকালয়ে স্থাপন করা হয়েছে। এসব ভাটায় ইট প্রস্তুতের জন্য জ্বালানি হিসাবে প্রতিনিয়ত পোড়ানো হচ্ছে কাঠ। এতে একদিকে কালো ধোঁয়াই দূষিত হচ্ছে পরিবেশ। স্বাস্থ্যঝুঁকিতে পড়ছেন শিক্ষার্থী, শিশুকিশোরসহ সাধারণ মানুষ। অন্যদিকে ভারসাম্য হারাচ্ছে পরিবেশ। নিয়মবহির্ভূতভাবে বছরের পর বছর দাপটের সাথে এসব ইটভাটা চললেও দেখার কেউ নেই। মাঝেমধ্যে লোক দেখানো কিছু অভিযান চললেও উদ্যোগ নেই স্থায়ী সমাধানের।
ঝিনাইদহ পরিবেশ অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, হরিণাকুণ্ডুতে ইটভাটার সংখ্যা ১৬টি। এর মধ্যে ১৩টি জিগজ্যাগ বাকি তিনটি হাওয়া। তবে এর একটিরও পরিবেশ অধিদপ্তরের ছাড়পত্র, জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ের লাইসেন্স বা অনুমোদন নেই। সবগুলোই অবৈধ। পরিচালিত হচ্ছে বেআইনিভাবে।
সরজমিনে ওই এলাকায় গিয়ে দেখা যায়, সেখানে একই জায়গায় পাশাপাশি বিশ্বাস ব্রিকস, রূমা, এ জেড ডাবলু, সোহান ও জামাত ব্রিকস নামে পাঁচটি ইটভাটা রয়েছে। প্রতিটির সামনে রয়েছে শত শত মন কাঠের স্তূপ। পাশেই রয়েছে উঁচু মাটির স্তূপ। অবস্য সামনে কিছু কয়লা থাকলেও সেগুলি লোক দেখানো। মূলত কাঠ দিয়েই পোড়ানো হচ্ছে ইট। এক ইটভাটা মালিক জানান, প্রতিদিন তার ভাটায় প্রায় ৪শ' মন কাঠ জ্বালিয়ে ইট পোড়ানো হয়। এসব কাঠ বরিশাল অঞ্চল থেকে সংগ্রহ করেন। নাম প্রকাশ না করার শর্তে এই এলাকার আরও এক ইটভাটা মালিক দাবি করেন, ছাড়পত্র বা অনুমোদন না থাকলেও সমস্যা হয় না। সংশ্লিষ্টদের ম্যানেজ করেই তারা ভাটা চালাচ্ছেন।
তথ্য সূত্রে মতে, প্রতিদিন উপজেলার ১৬টি ইটভাটায় প্রায় ৬ হাজার ৪ মন কাঠ পোড়ানো হয়। প্রতিমাসে কাঠ পোড়ানোর এই সংখ্যা দাঁড়ায় প্রায় ১ লাখ ৯২ হাজার মন। সেই হিসেবে বছরের নভেম্বর থেকে এপ্রিল মাস পর্যন্ত মৌসুমে এসব ভাটায় কাঠ পোড়ানো হয় প্রায় ১১ লাখ ৫২ হাজার। তবে তিনটি হাওয়া ভাটায় কাঠের পরিবর্তে কয়লা পোড়ানোই কাঠ পোড়ানোর এই সংখ্যা কিছুটা কম হতে পারে ধারণা কয়েকজন ভাটা মালিকের।
শিক্ষার্থী ও স্থানীয়রা বলছেন, লোকালয়ে আর সড়কের পাশে এসব ভাটা গড়ে ওঠাই ক্রমেই মানুষের স্বাস্থ্যঝুঁকি বাড়ছে । ইটভাটার কালো ধোঁয়ার পাশাপাশি গ্রামীণ সড়কে ইটবাহী ও মাটিবাহী ট্রাক চলাচলে উড়ছে ধুলাবালি। নষ্ট হচ্ছে গ্রামীণ সড়ক। দুর্ভোগ বাড়ছে শিক্ষার্থী, পথচারী ও যান চলাচলে। বর্ষা মৌসুমে সড়কে জমে থাকা ইটভাটার মাটি কর্দমাক্ত হয়ে অহরহ ঘটে দুর্ঘটনা। এছাড়া ধুলাবালিতে মানুষ আক্রান্ত হচ্ছে শ্বাসকষ্টসহ নানা রোগে। ধুলাবালির আবরণে বিবর্ণ হয়ে পড়ছে গাছপালা ও ঘরবাড়ি।
এক শিক্ষার্থী জানায়, এই এলাকা দিয়ে স্কুলে যাওয়ার সময় মুখে ওড়না পেঁচিয়ে যেতে হয়। পুরো শরীর ধুলোবালিতে ভরে যায়। এছাড়াও ইতোমধ্যে অনেকে শ্বাসকষ্টসহ নানান রোগে আক্রান্ত হয়েছে। সড়ক দিয়ে ইটভাটার মাটি টানার কারণে এই অবস্থা বলে দাবি এই শিক্ষার্থীর।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে স্থানীয় একব্যক্তি জানান, ব্যবসা বানিজ্যসহ নানান প্রয়োজনে তাঁদের প্রতিদিন এসব ইটভাটার পাশ দিয়ে জেলা ও উপজেলা শহরে চলাচল করতে হয়। এছাড়া এই সড়ক দিয়েই চিকিৎসার জন্য কুষ্টিয়া যাতায়াত করতে হয়। ইটভাটা মালিকরা এলাকার প্রভাবশালী তাই ভয়ে তাঁরা কাউকে কিছু বলতে পারেন না। কিন্তু এই এলাকায় আসলে ধুলোবালিতে মানুষ অসুস্থ হয়ে পড়ে। আর বর্ষায় সড়কে কাঁদা জমে দুর্ঘটনা ঘটে। দিনরাত ট্রাক আর স্থানীয়ভাবে তৈরি ইঞ্জিনচালিত যানে মাটি আর কাঠ টানা হয় বলেও জানান ওই ব্যক্তি।
ইট প্রস্তুত ও ভাটা স্থাপন নিয়ন্ত্রণ আইন-২০১৯ এবং ১৯৮৯ সালের ইট পোড়ানো নিয়ন্ত্রণ আইন (সংশোধিত-২০০১) অনুযায়ী স্থাপন করা হয়নি এই১৬টি ইটভাটার একটিও। এসবের একটিরও নেই ছাড়পত্র। তবুও চলতি বছর পুরোদমে চলছে ইট প্রস্তুতের কাজ। এর প্রায় সবগুলো লোকালয়ে আবার কয়েকটি গড়ে উঠেছে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ঘেঁষে। এতে একদিকে যেমন দূষিত হচ্ছে পরিবেশ অন্যদিকে আশঙ্কা বাড়ছে মানুষের স্বাস্থ্যঝুঁকিরও।
জেলা বন ও পরিবেশ অধিদপ্তরের কার্যালয় থেকে মাত্র তিন কিলোমিটার দূরে ঝিনাইদহ-হরিণাকুণ্ডু প্রধান সড়কের পারমথুরাপুর এলাকায় রয়েছে একটি মাধ্যমিক বিদ্যালয়। এখানে দুই শতাধিক শিক্ষার্থী রয়েছে। এই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের গাঁ ঘেঁষে গড়ে উঠেছে মেসার্স আসাদ জাহাঙ্গীর ব্রিকস। বিদ্যালয় ভবনের ২০০ মিটার এবং বিদ্যালয়ের মাত্র ২০ মিটারের মধ্যে ৭-৮ বছর আগে ভাটাটি স্থাপন করা হয়। তখন শিক্ষক, শিক্ষার্থী, অভিভাবক ও এলাকাবাসী বাধা দিলেও কর্ণপাত করেননি কর্তৃপক্ষ। এর প্রতিবাদে একাধিকবার মানববন্ধনসহ নানা কর্মসূচী পালিত হলেও কাজ হয়নি। তবে ২০২১ সালে স্কুল কর্তৃপক্ষের অভিযোগের ফলে এই ভাটাটি গুড়িয়ে দেয় প্রশাসন। কিন্তু অদৃশ্য শক্তির ইশারায় কয়েকমাস পর ফের চালু হয় এটি।
শিক্ষকদের অভিযোগ, তাঁদের স্কুলের সীমানার ৬৫ ফুটের মধ্যে গড়ে তোলা হয়েছে ভাটাটি। যেখানে গোটা মৌসুম কাঠ পুড়িয়ে ইট পোড়ানো হচ্ছে। এই ভাটার কালো ধোঁয়া আর উড়ে আসা বালি বিদ্যালয় ভবনে প্রবেশ করে শিক্ষার পরিবেশ নষ্ট করছে। এতে প্রায় সময় শিক্ষার্থীরা অসুস্থ হয়ে পড়ে।
বিদ্যালয়ের এক ছাত্রী জানায়, তাঁরা কষ্ট করে পড়ালেখা করে। বাতাস হলে চোখ মেলে চলাফেরা করা যায় না। কালো ধোঁয়া এসে শ্রেণিকক্ষে গন্ধ ছড়ায়। তাদের শ্বাস নিতে কষ্ট হয়। একই কথা জানায় আরও কয়েক শিক্ষার্থী ।
এছাড়াও প্রধান শিক্ষক লাবনী খাতুন বলেন, বিষয়টি নিয়ে তাঁরা খুব কষ্টে আছেন। ইটের ভাটা লোকালয়ের বাইরে স্থাপনের নিয়ম থাকলেও এটি করা হয়েছে স্কুলের সীমানা ঘেঁষে। এই ভাটার কারণে অনেক সময় বাচ্চারা অসুস্থ হয়ে পড়ে। প্রায়ই বাচ্চারা শরীর খারাপ লাগছে বলে ছুটি নিয়ে বাড়ি চলে যায়। মূলত ভাটার কালো ধোঁয়া আর উড়ে আসা বালু কনার কারণে বাচ্চারা অসুস্থ হচ্ছে। এই ইটভাটার আশেপাশে আরও দুটি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় রয়েছে।
সেখানকার অভিভাবক ও শিক্ষকরা জানান, বিদ্যালয়ে বাচ্চা পাঠিয়ে তাঁরা সারাক্ষণ চিন্তায় থাকেন কখন বাচ্চাটি অসুস্থ হয়ে পড়ে। বিদ্যালয় এলাকায় গেলে পোড়ামাটির গন্ধ নাকে এসে লাগে। চোখ মেলে হাঁটাচলা করলে বালুকনা উড়ে এসে পড়ে। সবচেয়ে বেশি সমস্যা কালো ধোঁয়ায়। দম বন্ধ হয়ে আসার উপক্রম হয়।
ইটভাটার মালিক জাহাঙ্গীর হোসেন বলেন, ভাটাটি বিদ্যালয়ের আরও কাছে ছিল। তাঁরা অনেকটা সরিয়ে নিয়েছেন। এখন যে স্থানে আছে এতে খুব একটা সমস্যা থাকার কথা নয়। ভাটায় কাঠ পোড়ানোর বিষয়ে তিনি জানান, তাঁরা কয়লা ব্যবহার করছেন। কিন্তু কিছু কিছু সময় কাঠের ব্যবহার প্রয়োজন হয়। সে কারণে ভাটায় কিছু কাঠ মজুত রেখেছেন। ইটের ভাটা পরিচালনার জন্য পরিবেশ অধিদপ্তরের কোনো অনুমোদন আছে কি না, এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, অধিদপ্তর কাউকেই অনুমোদন দিচ্ছে না।
একটিরও পরিবেশ অধিদপ্তরের ছাড়পত্র না থাকার কথা স্বীকার করে হরিণাকুণ্ডু ইটভাটা মালিক সমিতির সভাপতি জিয়াউর রহমান বলেন, তারা দীর্ঘদিন ধরে কর্তৃপক্ষের সাথে যোগাযোগ করছেন কিন্তু ছাড়পত্র বা অনুমতি দেওয়া হচ্ছে না। আর এই এলাকায় কোনো বনাঞ্চল নেই। তারা কয়লা দিয়ে ইট পোড়ান। তবে মৌসুমের শুরুতে অল্প কিছু কাঠের ব্যবহার করেন। এই কাঠ তারা জেলার বাইরে থেকে সংগ্রহ করেন। তবে স্থানীয়ভাবে মাটি সংগ্রহ করা হয়।
ঝিনাইদহ জেলা বন ও পরিবেশ অধিদপ্তরের সহকারী পরিচালক মুন্তাসির রহমান বলেন, আমরা গতবছর কয়েকটি ইটভাটায় অভিযান চালিয়েছি। সবগুলো ভাটা অবৈধভাবে চলছে। এর মধ্যে কয়েকটি ভাটা মালিকরা মহামান্য হাইকোর্টে রিট পিটিশন করেছেন। বাকিগুলোর বিরুদ্ধে দ্রুত আইনি ব্যাবস্থা নেওয়া হবে।
জেলা প্রশাসক মো. আব্দুল আওয়াল বলেন, আমরা ইতোমধ্যে এ বিষয়ে কাজ শুরু করেছি। যেসব ইটভাটার পরিবেশ অধিদপ্তরের ছাড়পত্র, লাইসেন্স কিংবা অনুমোদন নেই। দ্রুত সেগুলোর বিরুদ্ধে ব্যাবস্থা নেওয়া হবে।
আমার বাঙলা/এনআর