একদিনের ব্যবধানে নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জ উপজেলার পূর্বাচলের একটি লেকে ভেসে উঠেছে দুই কিশোর-কিশোরীর মরদেহ। তাদের একজন দ্বাদশ শ্রেণির ছাত্রী এবং অপরজন দশম শ্রেণির ছাত্র। দুই পরিবারের সদস্যরা বলছেন, তারা দুজন বন্ধু। বিজয় দিবসের দিন বিকালে তারা বাসা থেকে বেরিয়েছিলেন।
পুলিশ বলছে, দুই বন্ধু মোটরসাইকেল দুর্ঘটনার শিকার হয়েছেন। তাদের মোটরসাইকেলটিও লেক থেকে উদ্ধার করেছে পুলিশ। তবে, পুলিশের এই ভাষ্যে পুরোপুরি সন্তুষ্ট নন নিহতদের পরিবারের লোকজন। তারা দুইজনের মৃত্যুর ঘটনার সুষ্ঠু তদন্ত দাবি করেছেন।
বুধবার সকালে পূর্বাচল উপ-শহরের ৪ নম্বর সেক্টরের বউরারটেক এলাকার লেক থেকে ১৬ বছর বয়সী সাঁইনুর রশীদ কাব্যের মরদেহ উদ্ধার করেছে পুলিশ। ওই লেকেই পাওয়া যায় কাব্যের নীল রঙের মোটরসাইকেলটি।
রাজধানীর কাফরুল থানার কচুক্ষেত বউবাজারের হারুনুর রশীদের ছেলে কাব্য আদমজী ক্যান্টনমেন্ট স্কুল অ্যান্ড কলেজের ব্যবসায় শিক্ষা শাখার দশম শ্রেণির শিক্ষার্থী ছিল।
একদিন আগে মঙ্গলবার সকালে ভেসে ওঠে কাব্যের বন্ধু সুজানা আক্তারের মরদেহ। ওইদিন সুজানার ভ্যানিটি ব্যাগ ও একটি হেলমেট পাওয়া যায়।
প্রয়াত আব্বাস মিয়ার কন্যা ১৭ বছর বয়সী সুজানাও তার মা ও বড়ভাইয়ের সঙ্গে কাফরুল থানার কচুক্ষেত এলাকায় থাকতেন। তিনি ভাসানটেক সরকারি কলেজের বিজ্ঞান শাখার দ্বাদশ শ্রেণিতে পড়তেন।
সুজানার মা চম্পা বেগম জানান, বিজয় দিবসের সন্ধ্যায় টিউশনি করতে বাসা থেকে বের হন সুজানা। মেয়েকে বাসা থেকে রাস্তায় কিছু পথ এগিয়েও দিয়ে আসেন তিনি। এরপর আর বাসায় ফেরেননি এ কলেজছাত্রী। রাত ৯টার দিকে তার মোবাইল ফোন নম্বরে কল করলে সেটি বন্ধ পান মা।
কাঁদতে কাঁদতে তিনি বলেন, সারারাত মেয়ের জন্য টেনশন করছি। নানা জায়গায় খোঁজ-খবর করেও কোনো কিছু পাইনি। পরে থানায় যোগাযোগ করলে ওর মৃত্যুর খবর পাই। আমার মেয়ের এমন মৃত্যু হবে ভাবতেও পারিনি।
সুজানার বাবা মারা গেছেন চার বছর। বড়ভাই মেহেদী হাসান আহসানউল্লা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক পাস করে বেরিয়েছেন। চাকরি খুঁজছেন তিনি। বাবাহীন সুজানা নিজের পড়াশোনার খরচ চালানোর জন্য টিউশনি করতেন। একইসঙ্গে জানুয়ারিতে অনুষ্ঠিতব্য উচ্চ মাধ্যমিকের নির্বাচনি পরীক্ষারও প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন। চিকিৎসক হওয়ার স্বপ্ন ছিল সুজানার।
মা চম্পা বলেন, আমাদের ভালো ব্যবসা ছিল। ওর বাবা মারা যাওয়ার পর আমাদের আর্থিক পরিস্থিতি খারাপ হয়ে যায়। মেয়েটি আমার টিউশনি করে নিজের টুকটাক খরচ চালাত। নিজের পরীক্ষার জন্য কয়েকটি টিউশনি ছেড়ে দিয়েছিল। কত স্বপ্ন ছিল আমার মায়ের। ওর মুখটা আমি এখন কেমনে দেখমু, সহ্য করতে পারি না বাবা।
পরিবারের সদস্যরা জানান, জুলাই-আগস্টে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনেও সক্রিয় ছিলেন সুজানা। ছোটবেলা থেকে সাইকেল চালাতে পছন্দ করতেন। মোটরসাইকেল চালানোরও শখ ছিল তার। প্রায়শই বন্ধুদের সঙ্গে বাইকে করে ঘুরতে বেড়াতেন।
কাব্যর মা সোনিয়া রশিদ বলেন, নিজের মোটরসাইকেল নিয়ে প্রায়ই ঘুরতে বের হত কাব্য। ১৬ ডিসেম্বর সন্ধ্যায়ও মোটরসাইকেল নিয়ে বের হয় সে। রাত ৯টার দিকে সর্বশেষ মোবাইলে মায়ের সঙ্গে কথা হয় তার। যদিও পরে আর বাসায় ফেরেনি সে। বন্ধু-বান্ধব ও আত্মীয়-স্বজনের সঙ্গে যোগাযোগের পরও কাব্যের কোনো সন্ধান না পেয়ে রাজধানীর কাফরুল থানায় একটি সাধারণ ডায়েরিও (জিডি) করা হয়।
তিনি জানান, কাব্যের ফুফাতো ভাই আর সুজানা সহপাঠী। একই কোচিংয়ে যাতায়াতের সুবাদে সুজানার সঙ্গে কাব্যের পরিচয় হয়। মাসখানেক হয়েছে তাদের বন্ধুত্ব হয়েছে।
তিনি বলেন, সুজানা একাধিকবার আমাদের বাড়িতেও এসেছে। কিন্তু ১৬ ডিসেম্বর যে তারা দুজন একত্রে মোটরসাইকেল নিয়ে বেরিয়েছে তা জানতাম না। ওই রাতে কাব্য বাসায় না ফেরায় সুজানার আরেক বন্ধুকেও কল করেছিলাম, কিন্তু সেও তখন কিছু বলেনি। আমরা তখনো জানতাম না তারা দুজন ঘুরতে বেরিয়েছে। এমনটি জানলে সেই স্পটগুলোতেই তাদের খুঁজতাম।
সোনিয়ার দুই ছেলের মধ্যে কাব্য ছিল বড়। তার ছোট ছেলে শাহনূর রশীদ কল্প নৌবাহিনী স্কুল অ্যান্ড কলেজের পঞ্চম শ্রেণির ছাত্র।
কাব্যের মা সোনিয়া বলেন, পুলিশ জানিয়েছে, ওরা মোটরসাইকেল নিয়ে দুর্ঘটনা করেছে। কিন্তু আমার কাছে ব্যাপারটি এত স্বাভাবিক মনে হচ্ছে না। আমি রহস্যের গন্ধ পাচ্ছি। আমার কেবল দাবি থাকবে, পুলিশ যেন বিষয়টি নিয়ে ডিটেইলে তদন্ত করেন। আসলেই দুর্ঘটনা হয়েছে নাকি অন্য কিছু। দেশে তো কত কিছুই ঘটছে।
বুধবার দুপুরে নিজ কার্যালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে দুই শিক্ষার্থীর মৃত্যুর বিষয়ে কথা বলেন জেলা পুলিশ সুপার প্রত্যুষ কুমার মজুমদার। নারায়ণগঞ্জ শহরের আরেক বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীর হত্যাকাণ্ডের বিষয়ে ওই সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করা হয়েছিল।
তখন সাংবাদিকরা পূর্বাচলের দুই শিক্ষার্থীর প্রসঙ্গে জানতে চাইলে পুলিশ সুপার বলেন, প্রাথমিক তথ্য ও আলামতের ভিত্তিতে মনে হচ্ছে, দুই শিক্ষার্থী মোটরসাইকেলে থাকা অবস্থায় ওভারস্পিডের কারণে সড়ক দুর্ঘটনার শিকার হন এবং মোটরসাইকেলসহ তারা লেকে পড়ে যান। মোটরসাইকেলটি সুজানা চালাচ্ছিলেন বলেও আলামত পাচ্ছি। কিন্তু মৃত্যুর সঠিক কারণ জানার জন্য দুজনের মরদেহের ময়নাতদন্ত হবে। তা ছাড়া, আশপাশের এলাকার সিসিটিভি ক্যামেরার ভিডিও সংগ্রহের কাজ করছে পুলিশ। তিনি বলেন, তাদের মৃত্যুর পেছনে অন্য কোনো কারণ থাকলেও তা তদন্তে জানা যাবে।
এ ঘটনায় দুটি অপমৃত্যুর মামলা হয়েছে জানিয়ে রূপগঞ্জ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) লিয়াকত আলী বলেন, দুই পরিবারের পক্ষ থেকে দুটি মামলা হয়েছে। ময়নাতদন্তের পর মরদেহ দুটিও তাদের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে।
আমারবাঙলা/এমআরইউ