বিশ্বের বৃহত্তম ম্যানগ্রোভ শান্ত সুন্দরবন দীর্ঘদিন পর আবার ও অশান্ত হয়ে উঠছে। হঠাৎ করে সুন্দরবনে বনদস্যুদের তৎপরতায় অপহরণ, চুরি, ছিনতাই ও ডাকাতিসহ বিভিন্ন অপরাধ মূলককর্মকাণ্ড বেড়েই চলেছে। এতে করে সুন্দরবনের নদীতে মাছ ধরতে যাওয়া জেলে ও বাওয়ালিরা আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে পড়েছে। সুন্দরবন সাতক্ষীরা রেঞ্জে গত আগস্ট থেকে নভেম্বর পর্যন্ত ১৪ জেলে অপহরণের খবর পাওয়া গেছে। এর মধ্যে ১০ জেলেকে উদ্ধার করেছে বনবিভাগ।
এদিকে গত রবিবার সুন্দরবনের সাতক্ষীরা রেঞ্জের কলাগাছিয়া খাল থেকে রবিউল ইসলাম নামে (৩৫) এক জেলেকে অপহরণ করেছে সুন্দরবনের জলদস্যরা। অপহৃত রবিউল সাতক্ষীরা জেলার শ্যামনগর উপজেলার বুড়ি মোয়ালী ইউনিয়নের নীল ডুমুর গ্রামের মৃত আসির উদ্দিন ছেলে। অপহৃত রবিউল ইসলাম গত শনিবার সকালে একজন সহকর্মীকে নিয়ে বুড়ি গোয়ালিনী স্টেশন থেকে কাঁকড়া শিকারের (অনুমতিপত্র) পাস নিয়ে সুন্দরবনের প্রবেশ করে কাঁকড়া ধরার সময় সশস্ত্র তিন বনদস্যু অস্ত্রের মুখে রবিউলকে অপহরণ করে নিয়ে যাই। যাওয়ার সময় তারা নিজেদেরকে মজনু বাহিনীর সদস্য পরিচয় দিয়ে পরবর্তীতে তার বাড়িতে যোগাযোগ করে বিকাশের মাধ্যমে মুক্তিপনের টাকা নিয়ে তাকে ছেড়ে দেবে বলে রবিউলের সহকর্মীকে জানিয়ে দেয়।
এ ব্যাপারে সাতক্ষীরা রেঞ্জের সরকারি বন সংরক্ষক (এসি এফ) কর্মকর্তা হাসানুর রহমান এর কাছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, কোন তেলের অপহরণ সম্পর্কে আমাদেরকে এখনো কোন কিছু কেউ জানায়নি। আমাদেরকে অপহরণকারীর স্বজনরা অপহরনের তথ্য না দেওয়ার কারণে আমাদেরকে বিভিন্ন সমস্যার সম্মুখীন হতে হয়। সুন্দরবনে বনদস্যদের তৎপরতা হঠাৎ করেই বৃদ্ধি পেয়েছে বলে স্বীকার করে বলেন অভিযোগ পেলেই আমরা দ্রুত অপহরণ ব্যক্তির মুক্তির ব্যাপারে ব্যবস্থা ও বনদস্যদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেব।
স্থানীয় সূত্র জানা যায়, নতুন করে বিভিন্ন ডাকাত দলকে বনের বিভিন্ন এলাকায় বিচরণ করতে দেখেছে স্থানীয়রা।
জানা যায়, ছয় বছর আগে বনদস্যুদের আত্মসমর্পণের মধ্য দিয়ে ২০১৮ সালের নভেম্বরে সুন্দরবনকে দস্যুমুক্ত ঘোষণা করা হয়। ঘোষণার পর দীর্ঘদিন বনদস্যদের তৎপরতা থেমে থাকলেও বর্তমানে এখন আবারও সুন্দরবনে বনদস্যুরা তৎপর হয়ে উঠেছে।
জেলেরা বলছেন, রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর সাতক্ষীরা জেলা কারাগার থেকে পালানো দাগি আসামি এবং ছয় বছর আগে আত্মসমর্পণ করা দস্যুরা ফের দস্যুতায় যোগ দিয়েছে। জেলে অপহরণ করে মুক্তিপণ দাবি, মাছ ছিনতাই, চাঁদা আদায়সহ নানা ধরনের অপরাধ ঘটছে বলে ভুক্তভোগীরা জানিয়েছেন। মঙ্গলবার (১২ নভেম্বর) রাতে দুই লাখ টাকা মুক্তিপণের বিনিময়ে বাড়ি ফিরেছে সুন্দরবনে বনদস্যু মজনু বাহিনীর হাতে অপহৃত এক জেলে। জিম্মিদশা থেকে মুক্ত হয়ে ফিরে আসা জেলে আতাহার হোসেন (৩৫) ও রুহিন সানা যথাক্রমে খুলনার কয়রা উপজেলার কালিকাপুর গ্রামের শফিকুল বিশ্বাস ও রহিম সানার ছেলে। একই বনদস্যু দলের সদস্যরা আতাহার ও রুহিনকে মুক্ত করে দেওয়ার সময় আবু বক্কার গাজী নামে অপর এক জেলেকে জিম্মি করেছে বলে জানা গেছে।
এর আগে গত ৪ নভেম্বর রাতে সুন্দরবন সাতক্ষীরা রেঞ্জের চুনকুড়ি নদীর তক্কাখালী এলাকায় বনদস্যুর কবল থেকে ১০ জেলেকে উদ্ধার করে বন বিভাগ। উদ্ধার হওয়া জেলেরা হলেন উপজেলার চুনকুড়ি গ্রামের আলিম গাজী, নুরুল ইসলাম, রবিউল ইসলাম, হাফিজুর রহমান, মফিজুর রহমান, মুছাক সানা, শফিকুল গাজী, নজরুল ইসলাম ও রফিকুল মল্লিক। এ সময় রীতিমতো দুপক্ষের মধ্যে বন্দুকযুদ্ধ হয়। বনদস্যুদের আস্তানা গুঁড়িয়ে দিয়ে তিনটি নৌকা, সোলার প্যানেল ও এক রাউন্ড গুলি উদ্ধার করে বন বিভাগ।
এদিকে, রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের সর্বপ্রথম গত ২০ আগস্ট রাত সাড়ে ১২টার দিকে পশ্চিম সুন্দরবনের সাতক্ষীরা রেঞ্জে শফিকুল গাজী (৪৫) নামে এক জেলেকে অপহরণ করে বনদস্যুরা। পরে গত ১০ নভেন্বরের অভিযানে শফিকুলকে উদ্ধার করে বন বিভাগ।
সম্প্রতি মুক্তিপণ দিয়ে ফিরে আসা ও বনদস্যুদের হাত থেকে উদ্ধার হওয়া জেলেদের কাছ থেকে জানা যায়, সাতক্ষীরার শ্যামনগর উপজেলাজুড়ে বিস্তৃতি পশ্চিম সুন্দরবনে ও খুলনা কয়রা ও দাকব অঞ্চলের আসাবুর বাহিনী, শরীফ বাহিনী, আবদুল্লাহ বাহিনী, মঞ্জুর বাহিনী, দয়াল বাহিনী নামে বনদস্যুদের নতুন কয়েকটি দল তৎপরতা শুরু করেছে।
সর্বশেষ ফিরে আসা জেলে আতাহার হোসেন জানান, গত ৮ নভেম্বর সকালে পশ্চিম সুন্দরবনের সাতক্ষীরা রেঞ্জের হাঁড়িভাঙ্গা নামীয় এলাকা থেকে বনদস্যুরা তাদের অপহরণ করে। এ সময় তারা পরিবারের সদস্য এবং মহাজনের নাম্বার ও নাম নেয়। সোমবার (১১ নভেম্বর) মুক্তি পেয়ে মঙ্গলবার (১২ নভেম্বর) রাতে তারা হরিনগর এলাকার চুনকুড়ি খাল দিয়ে লোকালয়ে ফিরে আসেন। মুক্তিপণের বিষয়ে তাদের মহাজন জানেন বলে উল্লেখ করেন তিনি।
ফিরে আসা জেলের মহাজন জানান, অপহরণের পর বনদস্যুরা ৪ লাখ টাকা মুক্তিপণ দাবি করেছিল। পরে মুক্তিপণের অঙ্ক কমিয়ে ২ লাখ টাকা নির্ধারণ করে দেয়। রোববার (১০ নভেম্বর) বিকাশযোগে ২ লাখ টাকা পরিশোধের পর বনদস্যুরা সোমবার রাতে অন্য একটি জেলে নৌকায় তাদের উঠিয়ে দেয়। মঙ্গলবার রাতে তারা পরিবারের কাছে পৌঁছেছেন।
ফিরে আসা জেলেদের দাবি, ২০১৮ সালে র্যাব-৮ এর হাতে আত্মসমর্পণ করা বনদস্যু মজনু আবারও সুন্দরবেন দস্যুতা শুরু করেছে। তিনটি আগ্নেয়াস্ত্রসহ ৭-৮ জন সহযোগীকে নিয়ে সে আবারও জেলে অপহরণসহ মুক্তিপণ আদায়ে তৎপরতা চালাচ্ছে। বিপুল কোম্পানির নৌকাযোগে তিন সপ্তাহ আগে এসব বনদস্যু সুন্দরবনে প্রবেশ করেছে বলে অপহরণ ব্যক্তির স্বজনরা জানান।
বন বিভাগ ও পুলিশ সূত্রে জানা গেছে, ২০১৬ থেকে ২০১৮ সালের অক্টোবর পর্যন্ত ধাপে ধাপে সুন্দরবন অঞ্চলের ৩২টি দস্যু বাহিনীর ৩২৮ জন দস্যু ৪৬২টি অস্ত্র ও ২২ হাজার ৫০৪টি গোলাবারুদসহ আত্মসমর্পণ করেছিলেন। পরে ২০১৮ সালের ১ নভেম্বর প্রাণবৈচিত্র্যে ভরা সুন্দরবনকে ‘দস্যুমুক্ত’ ঘোষণা করা হয়।
গত ৪ নভেম্বর বন বিভাগের উদ্ধার সুন্দরবনে মাছ ধরতে গিয়ে অপহরণের শিকার জেলেরা জানান, তাদের কয়েক জনকে টগিবগি এলাকা থেকে অস্ত্রের মুখে অপহরণ করে দস্যুরা। এরপর হাত-মুখ বেঁধে আটকে রাখে। তাদের পরিবারের কাছে ফোন করে এক লাখ টাকা করে চাঁদা দাবি করে। এ বিষয়ে পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে যোগাযোগ করলে তারা ৩০ হাজার টাকা বিকাশের মাধ্যমে পাঠান। পরে একজনকে ছেড়ে দিয়ে বাকি টাকা দিলে অন্যদের ছাড়ার কথা বলে।
জেলেরা জানান, সুন্দরবনে ১০-১২ জনের একটি ডাকাত দল জেলেদের কাছে যা পাচ্ছে সব নিয়ে নিচ্ছে। তারা প্রশাসনের দ্রুত পদক্ষেপ নেওয়ার অনুরোধ করেছেন।
সাতক্ষীরা জেলা কারাগারের ভারপ্রাপ্ত জেল সুপার মোহাম্মদ এনায়েত উল্যা বলেন, ‘কারাগার থেকে পালানোর ঘটনার পর সদর থানায় ৮৭ জন হাজতি ও কয়েদির নামে মামলা দায়ের করা হয়েছে। এর মধ্যে ৩৩ জন ফিরে আসে। এখনও ৫৪ জন বাইরে রয়েছে। এর মধ্যে দুই জন রয়েছে ফাঁসির আদেশপ্রাপ্ত।
র্যাব-৬ সাতক্ষীরা ক্যাম্পের ভারপ্রাপ্ত কোম্পানি কমান্ডার মো. জিয়াদ বলেন, ‘জেলা আইনশৃঙ্খলা কমিটির মিটিংয়ে বনদস্যদের ব্যাপারে আমি কথা বলেছি। আমারা পুরাতন বনদস্যুদের ব্যাপারে খোঁজখবর নিচ্ছি। পাশাপাশি দস্যুমুক্ত সুন্দরবনে কেউ নতুন করে আতঙ্ক সৃষ্টি করতে চাইলে কঠোর হাতে দমন করা হবে। জেলেদের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ রাখে র্যাব। এ ধরনের কোনও ঘটনার খবর পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে আমরা অভিযান জালাচ্ছি। নতুন করে কেউ আতঙ্ক সৃষ্টি করার চেষ্টা করলে আমরা কঠোর হাতে দমন করবো।’
বনবিভাগের কদমতলা ফরেস্ট স্টেশনের এসও সোলায়মান বলেন, ‘গত ৩ নভেম্বর সুন্দরবনের চুনকুড়ি নদীর তক্কাখালী এলাকায় অভিযান চালানো হলে বনদস্যু বাহিনীর সদস্যরা বন বিভাগের সদস্যদের লক্ষ্য করে গুলি ছোড়ে। জবাবে বন বিভাগের সদস্যরাও পাল্টা গুলি করে। এ সময় প্রতিরোধের মুখে বনদস্যুরা পালিয়ে যায়। ধ্বংস করা হয় বনদস্যুদের একটি আস্তানা।’
ওই বন কর্মকর্তা আরও বলেন, ‘দীর্ঘদিন সুন্দরবন সাতক্ষীরা রেঞ্জ বনদস্যুমুক্ত থাকার পর অতিসম্প্রতি আবারও বনদস্যুদের কয়েকটি বাহিনী বেপরোয়া হয়ে উঠেছে। এই বাহিনীর অত্যাচারে জেলে-বাওয়ালিরা আতঙ্কিত হয়ে পড়েছে। ভিন্ন নামে ভিন্ন পরিচয়ে ভারতে বসে এই বনদস্যু গ্রুপটি জেলেদের কাছে মোবাইল ফোনে চাঁদা দাবি করছে বলে জেলে-বাওয়ালিরা অভিযোগ করেছেন।
আমার বাঙলা/এনবি