গাজীপুরে ইসলামিক ইউনিভার্সিটি অব টেকনোলজির (আইইউটি) পিকনিক বাসে বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়ে তিন শিক্ষার্থীর মৃত্যুর ঘটনায় ময়মনসিংহ পল্লী বিদ্যুৎ সমিতি-২-এর সাত কর্মকর্তা ও কর্মচারীকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছে।
শনিবার (২৩ নভেম্বর) রাত সাড়ে ১১টায় এ তথ্য নিশ্চিত করেছেন ময়মনসিংহ পল্লী বিদ্যুৎ সমিতি-২-এর জেনারেল ম্যানেজার (জিএম) মো. আকমল হোসেন।
তিনি বলেন, শনিবার সকালে গাজীপুরে আইইউটি’র পিকনিক বাসে বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়ে তিন শিক্ষার্থীর মৃত্যু হয়। এ ঘটনার পরপরই বাংলাদেশ পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ডের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেন।
রাতে এ ঘটনায় ময়মনসিংহ পল্লী বিদ্যুৎ সমিতি-২-এর ডেপুটি জেনারেল ম্যানেজার (ডিজিএম, সদর-কারিগরি) কমলেশ চন্দ্র বর্মন, মাওনা জোনাল অফিসের ডেপুটি জেনারেল ম্যানেজার (ডিজিএম) খোন্দকার মাহমুদুল হাসান, এজিএম মো. তানভীর সালাউদ্দিন, জুনিয়র ইঞ্জিনিয়ার মতিউর রহমান, লাইনম্যান পারভেজ মিয়া শাখাওয়াত হোসেন ও আবুল কাশেমকে সাময়িক বরখাস্ত করে বাংলাদেশ পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ড।
জানা যায়, শ্রীপুর উপজেলার জৈনাবাজারে একটি রিসোর্টে বনভোজনে যাচ্ছিলেন আইইউটি’র শিক্ষার্থীরা। তাদের বহনকারী দ্বিতল বাস ১১ হাজার ভোল্টের বিদ্যুৎ লাইনের সংস্পর্শে এলে ঘটে দুর্ঘটনা। ঝুলে থাকা অনাবৃত তারের কারণে বিদ্যুৎস্পর্শে তিন শিক্ষার্থী প্রাণ হারান। গুরুতর আহত হন আরো কয়েকজন। শনিবার সকাল সাড়ে ১০টার দিকে শ্রীপুরের উদয়খালী গ্রামে এ ঘটনা ঘটে।
নিহতরা হলেন– আইইউটির মেকানিক্যাল অ্যান্ড প্রডাকশন ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের তৃতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী মোজাম্মেল হোসেন নাঈম, মোস্তাকিম রহমান মাহিন ও জোবায়ের আলম সাকিব। গুরুতর আহত একই বর্ষের শিক্ষার্থী কাবিদুল ইসলাম আলিফ ও নাফিজ আলম খান চিকিৎসাধীন।
মেধাবী তিন তরুণের এমন মৃত্যুতে ভেঙে পড়েছেন তাদের স্বজনরা। এ ঘটনায় শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের মধ্যে শোকের ছায়া নেমে এসেছে। ঘটনা তদন্তে গাজীপুর জেলা প্রশাসন ও আইইউটির পক্ষ থেকে আলাদা কমিটি করা হয়েছে।
সংশ্লিষ্টরা জানান, আইইউটির মেকানিক্যাল অ্যান্ড প্রডাকশন ইঞ্জিনিয়ারিং ও ইলেকট্রিক্যাল অ্যান্ড ইলেকট্রনিক ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের বার্ষিক বনভোজন ছিল। গাজীপুরের বোর্ডবাজার এলাকায় বিশ্ববিদ্যালয়টির ক্যাম্পাস থেকে সকালে ছয়টি বাস জৈনাবাজারের মাটির মায়া রিসোর্টের উদ্দেশে রওনা হয়। সেগুলোয় ছিলেন ৪৬০ শিক্ষার্থী। এর মধ্যে শেষের বাসটি উদয়খালী এলাকায় রিসোর্টের কাছে পৌঁছে বিদ্যুতায়িত হয়।
সরেজমিন দেখা যায়, গ্রামের ভেতর দিয়ে চলে গেছে পিচঢালা সরু রাস্তা। একটি বাস বা ট্রাক ওই রাস্তায় চললে বিপরীত দিক থেকে আসা কোনো বাহন স্বাভাবিকভাবে চলতে পারে না। রাস্তার একপাশে রয়েছে বেশ পুরোনো ১১ হাজার ভোল্টের বিদ্যুৎ সঞ্চালন লাইন। বিদ্যুতের দু’পাশের খুঁটি অনেক দূরে হওয়ায় মাঝখানে তার নিচের দিকে ঝুলে গেছে। ওই রাস্তা দিয়েই যাচ্ছিল শিক্ষার্থীদের বহনকারী বিআরটিসির দোতলা বাস।
প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, পাঁচটি বাস নিরাপদে রিসোর্টে চলে যায়। সবচেয়ে পেছনে থাকা বাসটি রাস্তার একপাশে দাঁড়িয়ে একটি অটোরিকশাকে যাওয়ার সুযোগ করে দিচ্ছিল। এ সময় রাস্তার বিদ্যুতের তার স্পর্শ করে দোতলা বাসের ছাদ। মুহূর্তে পুরো বাস বিদ্যুতায়িত হয়ে যায়। বাসের ভেতরে ছটফট করতে থাকেন শিক্ষার্থীরা। কারো হাত, কারো মুখসহ শরীরের বিভিন্ন অংশ ঝলসে যায়। তাদের চিৎকার শুনে এগিয়ে যান এলাকাবাসী। তারা দ্রুত বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধের জন্য ফোন করেন বিদ্যুৎ অফিসে। এরই মধ্যে শিক্ষার্থী মোজাম্মেল হোসেন নাঈম মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন। তিনি ফেনী সদরের মাস্টারপাড়া মুন্সী বাড়ির মোতাহার হোসেনের ছেলে।
গুরুতর আহত কয়েকজনকে উদ্ধার করে দ্রুত ময়মনসিংহ মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে নেওয়া হয়। সেখানে শিক্ষার্থী মোস্তাকিম রহমান মাহিন ও জোবায়ের আলম সাকিবকে চিকিৎসক মৃত ঘোষণা করেন। নিহত মাহিন রংপুর সদরের ইসতিয়াজুর রহমানের ছেলে এবং সাকিব রাজশাহীর ডিংগাডুব রাজপাড়া এলাকার জাহাঙ্গীর আলমের ছেলে। গুরুতর আহত শিক্ষার্থী কাবিদুল ইসলাম আলিফ ও নাফিজ আলম খানকে ময়মনসিংহ মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল থেকে পরে ঢাকায় পাঠানো হয়।
শিক্ষার্থীরা জানান, বাসের নিচতলায় থাকা মাহিন দোতলায় তার বন্ধুর ব্যাগ আনতে যাচ্ছিলেন। ওই সময় বাসটি একপাশে হেলে যায়। তখন বাসের পেছনের দরজার কাছে থাকা মাহিন বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়ে ছটফট করতে থাকেন। তাকে দেখে এগিয়ে যান বন্ধু সাকিব। তিনি ছাড়া আরো কয়েকজন বিদ্যুৎস্পৃষ্টে আহত হন। পরে তাদের উদ্ধার করে হাসপাতালে নেওয়া হয়।
বনভোজনে যাওয়া শিক্ষার্থীদের অভিযোগ, গ্রামীণ সরু সড়কে কেন দোতলা বাস নিয়ে যাওয়া হলো? পিকনিক স্পট ভাড়া নেওয়ার আগে এ ব্যাপারে জেনে নেওয়া দরকার ছিল। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ এসব বিষয় চিন্তা করেনি। রিসোর্ট কর্তৃপক্ষও বিষয়টি আয়োজকদের জানানি। তাই কোনো পক্ষই এ ঘটনার দায় এড়াতে পারে না।
আইইউটির ভারপ্রাপ্ত উপ-উপাচার্য অধ্যাপক মোহাম্মদ রাকিবুল ইসলাম বলেন, দুর্ঘটনা তো আর বলে আসে না। এখন কাউকে দোষ দেওয়ার চেয়ে পরিস্থিতির উত্তরণে সবাইকে কাজ করতে হবে। এ ঘটনায় বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ তদন্ত কমিটি গঠন করেছে।
আমারবাঙলা/এমআরইউ