ভিজিএফ কর্মসূচির আওতায় কুড়িগ্রামের রাজীবপুর-রৌমারীতে ৯টি ইউনিয়নের হতদরিদ্রেরদের নামে কার্ড করার ক্ষেত্রে স্বজনপ্রীতি, দেরিতে বিতরণ, প্রকৃত গরীবের নাম বাদ দিয়ে ধনীদের নাম অন্তর্ভুক্তকরণ, তালিকায় বিএনপি, যুবদল, ছাত্রদল, নেতাকর্মীদের নাম, এছাড়া চেয়ারম্যান-মেম্বারদের স্বজনদের নাম, একই পরিবারে একাধিক কার্ড ও ভুয়া, মৃত্যু ব্যক্তি ও প্রবাসীদের নামও বাদ পরেনি তালিকা থেকে।
দফায় দফায় তারিখ পরিবর্তন করেছে চেয়ারম্যানরা। এ যেন চাল নিয়ে চালবাজি। বিভিন্ন জনের কাছ থেকে এমন সীমাহীন অনিয়ম-দুর্নীতির অভিযোগ পাওয়া গেছে। এসব অভিযোগ নিয়ে একাধিক সুবিধাবঞ্চিত ব্যক্তি প্রশাসনের বিভিন্ন দপ্তরে গেলেও কোনো লাভ হয়নি। অবশেষে কয়েকটি ইউপিতে দু গ্রুপের সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। এতে কমপক্ষে ১০/১২ জন আহত হয়।
প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তার কার্যালয় (পিআইও) ও সংশ্লিষ্ঠ সূত্রে জানা যায়, ২০২৪-২০২৫ অর্থ বছরে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয় অর্থায়নে আসন্ন পবিত্র ঈদুল ফিতর উপলক্ষে দুস্থ ও অতি দরিদ্র, অসহায় পরিবারের মাঝে ভিজিএফ কর্মসূচির আওতায় খাদ্যশস্য প্রদানের লক্ষ্যে অসহায় ও দুস্থ পরিবারের মাঝে খাদ্যশস্য সহায়তা (ভিজিএফ) প্রদানের লক্ষ্যে রাজিবপুর-রৌমারীতে ৯টি ইউনিয়নের ৮১টি ওয়ার্ডে ভিজিএফ কর্মসূচির বিপরীতে ৬৭, ৬৩৯ জন উপকারভোগীর জন্য ৬৭ হাজার ৬৩৯ মেট্রিক টন চাল বরাদ্ধ পাওয়া যায়।
সরকারি নীতিমালা অনুযায়ী, তৃণমূল জনগোষ্ঠীর চাহিদার ভিত্তিতে তালিকা প্রণয়ন তৈরি করা হবে। প্রতিজন উপকারভোগী ১০ কেজি চাল পাওয়ার কথা। চাল বিতরণের সময় উপজেলা প্রশাসন কর্তৃক মনোনীত ট্যাগ অফিসার উপস্থিত থাকবেন। অথচ স্লিপের মাধ্যমে অগ্রাধিকার তালিকা ও মাস্টাররোল ছাড়া কোথাও বালতি, কোথাও মগ, কোথাও তিনজন মিলে এক বস্তা দেওয়া হয়। এক্ষেত্রে কোন নীতিমালা অনুসরণ করা হয়নি। কার্ড বন্টনে রাজনৈতিক কোটা রাখা হয়েছে। জনপ্রতিনিধি ও রাজনৈতিক দলের নামে ভাগাভাগি করা হয়েছে।
কর্মসূচির শুরুতে রৌমারী-রাজীবপুর, কোদালকাটি, মোহনগনজসহ রৌমারীর সব ইউনিয়নের বিভিন্ন এলাকা সরজমিনে উপকারভোগীদের সঙ্গে আলাপ করে জানা গেছে কর্মসূচির বিভিন্ন অনিয়ম, দুর্নীতি ও স্বজনপ্রীতির কথা।
যাদুরচর ইউনিয়নে দেখা গেছে তালিকায় থানা ও যুবদল, ছাত্রদল ও ব্যবসায়ী ইব্রাহিম, প্রবাসী লালমিয়া, আলতাবের নাম তালিকাভুক্ত রয়েছে। এ ছাড়াও একই পরিবারে একাধিক কার্ড ও ডাবলকার্ডও রয়েছে।
রাজিবপুর সদর ইউনিয়নের জন্য ১০ হাজার একশত ৫৯টি কার্ড বরাদ্দ করা হয়। অথচ ইউনিয়ন পরিষদে কার্ড বন্টনে রাজনৈতিক কোটা রাখা হয়েছে। তার মধ্যে ১২ জন মেম্বারকে দেওয়া হয়েছে পাঁচ হাজার ৬০০, বিএনপি ১০০০, জামাত ৫০০, ভূমিহীন ১০০, সমন্বয়ক ১০০, ১২টি আশ্রয়কেন্দ্রের নামে ১০০০ ও চেয়ারম্যান নিজের নামে ২,১০০ নাম রাখেন।
উপজেলা নির্বাহী অফিসারের নির্দেশনা অনুযায়ী, গত ১৯ মার্চ থেকে বিতারণ শুরু করা হয়। প্রতি কার্ডধারীকে ১০ কেজি করে চাউল পাওয়ার কথা থাকলেও তা মানা হয়নি। এ ছাড়া ভিজিএফের চাউল বিতরণে অনিয়মকে কেন্দ্র করে দু’গ্রুপে দফায় দফায় সংঘর্ষ হয়ে আহত হন পাঁচজন।
অপরদিকে কোদালকাটি ইউনিয়নে গিয়ে দেখা যায়, পরিষদের ভেতরে একটি টেবিলের কাছে মাস্টাররুলে স্বাক্ষর নিয়ে ৩ জন মিলে একটি বস্তা দেওয়া হচ্ছে সহকারী কমিশনার (ভূমি) পিআইও এবং ট্যাগ অফিসার। চরশৌলমারী ইউনিয়নে গিয়ে দেখা গেছে, আব্দুল মমিন মেম্বার এক ব্যক্তির নিকট ৫টি টিপ নিয়ে এক বস্তা চাউল দিচ্ছে। একই অবস্থা সকল ইউনিয়নের।
এ নিয়ে উপকারভোগীরা অভিযোগ করে বলেন, ‘আমরা আর কত কষ্ট করবো। আমাদেরকে ১০ টাকা করে প্রতি কার্ডে দিতে হয়। এছাড়া প্রত্যেকটি ইউনিয়নে নীতিমালা অনুসারে কাজ করছে না। কোথাও কোথাও বিতরণে অনিয়ম, ওজনে কম দিতে দেখা গেছে।
উপজেলায় রাজীবপুর-রৌমারী ভিজিএফ কর্মসূচির বিভিন্ন সমস্যা ও সম্ভাবনা নিয়ে আমিনুল ইসলাম হতরিদ্রদের বাদ দিয়ে ধনী, প্রভাবশালী ও প্রবাসী ব্যক্তিদের নাম অর্ন্তভুক্ত করে কার্ড দেওয়া হচ্ছে।
মুক্তিযোদ্ধা জয়নাল জানান, তালিকায় শতকরা ৪০ ভাগ ধনী ব্যক্তির নাম অর্ন্তভুক্ত রয়েছে। চেয়ারম্যানদের পছন্দের নামও বাদ পড়েনি। মিলন মেম্বর বলেন, তালিকা দফায় দফায় পরিবর্তন করেছে চেয়ারম্যানরা।
এ ব্যাপারে রৌমারী বিএনপির আহবায়ক আব্দুর রাজ্জাক বলেন, চাল নিয়ে চালবাজি চলবে না। সরকারের ভাবমূর্তি ক্ষুন্ন করে যারা এসব অনিয়ম, দুনীতি ও স্বজনপ্রীতি করবে তাদেরকে ছাড় দেওয়া হবে না। এসব তালিকা খতিয়ে দেখা হবে। অনিয়ম দুনীর্তি তদন্ত টিম গঠনপুর্বক যাচাই বাছাই করা হবে। প্রয়োজনে এসব তালিকা পরির্বতনসহ নতুনভাবে শ্রমিকদের নিয়োগের ব্যবস্থা করা হবে।
এব্যাপারে জানতে চাইলে রৌমারী উপজেলা প্রকল্প কর্মকর্তা মো. শামস উদ্দীন বলেন, তালিকায় কোন ধনী ব্যক্তির নাম দেওয়ার নিয়ম নেই। কোন ধনী ব্যক্তির নাম পাওয়া গেলে সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেয়া হবে। ইতোমধ্যে তালিকা সংশোধন ও নতুনভাবে কার্ড ফেরত দিয়েছে কর্তৃপক্ষ।
এ ব্যাপারে ভারপ্রাপ্ত রাজীবপুর উপজেলা নিবার্হী অফিসার ফজলে এলাহী বলেন, ‘আমি একাধিক মৌখিক অভিযোগ পেয়েছি। বিষয়টি তদন্ত করে দেখা হচ্ছে। অভিযোগ সত্য হলে তাদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’
আমারবাঙলা/জিজি