রাজবাড়ী জেলার পরিচিতি পদ্মা কন্যা রাজবাড়ী। এই জেলার উত্তর দিয়ে বয়ে গেছে প্রমত্তা পদ্মা নদী, যার শাখা গড়াই নদীসহ আরও ছয়টি নদী এবং ৫৪টি খাল প্রবাহিত হয়েছে জেলার বিভিন্ন অংশে। তবে শুষ্ক মৌসুমে পদ্মা শুকিয়ে যাওয়ায় এসব নদী ও খাল হয়ে যায় পানি শূন্য, যার প্রভাব পড়েছে কৃষিতে।
শুষ্ক মৌসুমে রাজবাড়ীর নদীগুলোতে পানি কমে যাওয়ায় কৃষিকাজের জন্য ভূগর্ভস্থ পানির ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়তে হয় কৃষকদের। প্রতিবারই ভূগর্ভস্থ পানির স্তর নিচে নেমে যাচ্ছে, ফলে সেচকাজ ব্যাহত হচ্ছে। বিশেষ করে মার্চ থেকে মে মাসের মধ্যে টিউবওয়েল ও শ্যালো মেশিন দিয়ে পানি তোলা কঠিন হয়ে পড়ে। কৃষকদের মতে, প্রতি বছর পানির স্তর আরও নিচে নেমে যাওয়ায় খরচ বাড়ছে এবং সেচ কার্যক্রম চালিয়ে যাওয়া কঠিন হয়ে পড়ছে।
পাংশা উপজেলার নাদুরিয়া গ্রামের বাসিন্দা শহীদ মুন্সি বলেন, "আমাদের গ্রাম একদিকে গড়াই নদী, অন্যদিকে সিরাজপুর হাওর ঘেরা। কিন্তু শীতের পর সিরাজপুর হাওরে পানি থাকে না, আর গড়াই নদীতে হাঁটু সমান পানি থাকে। চৈত্র মাসে টিউবওয়েলে পানি ওঠে না, মোটর ছাড়া কোনো উপায় নেই।"
পাংশা উপজেলার সরিষা ইউনিয়নের কৃষক কার্তিক শীল বলেন, "নদী বা খালের পানি কৃষিকাজে ব্যবহার করা যায় না। চৈত্র ও বৈশাখ মাসে শ্যালো মেশিনে পানি ওঠে না, তখন গর্ত করে শ্যালো বসাতে হয়। প্রতি বছর গর্ত আরও গভীর করতে হচ্ছে, এতে খরচও বাড়ছে।"
রাজবাড়ী সদর উপজেলার খানগঞ্জ গ্রামের শহীদুল ইসলাম জানান, "একসময় হড়াই নদীতে ইলিশ মাছ পাওয়া যেত, নৌকা চলত। এখন নদী খালে পরিণত হয়েছে, তিন মাস পানি থাকে, বাকি নয় মাস শুকিয়ে যায়।"
রাজবাড়ী কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক ড. মো. শহীদুল ইসলাম বলেন, "নদীর পানি শুকিয়ে যাওয়ার কারণে মাঠের খালগুলোতেও পানি থাকে না। ফলে কৃষকরা বাধ্য হয়ে ভূগর্ভস্থ পানি ব্যবহার করছেন। তবে শুকনো মৌসুমে ভূগর্ভস্থ পানির স্তর নিচে নেমে যাওয়ায় সেচকাজ ব্যাহত হচ্ছে। এই অবস্থা চলতে থাকলে ভবিষ্যতে আরও সংকট দেখা দেবে।"
রাজবাড়ী জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. আবু জাকারিয়া বলেন, "ভূগর্ভস্থ পানির ৯৫% কৃষিকাজে ব্যবহৃত হয়, আর মাত্র পাঁচ% খাবার ও অন্যান্য কাজে ব্যবহৃত হয়। কিন্তু প্রতি বছর উত্তোলিত পানির সমপরিমাণ পুনরায় ভূগর্ভে জমা হয় না। ফলে পানির স্তর নিচে নামছে এবং টিউবওয়েলে পানি উঠছে না।"
রাজবাড়ী পানি উন্নয়ন বোর্ডের উপ-বিভাগীয় প্রকৌশলী এম.এ. শামীম বলেন, "রাজবাড়ীর নদীগুলো মূলত পদ্মা নদীর পানির ওপর নির্ভরশীল। তবে ডিসেম্বর থেকে জুন পর্যন্ত পদ্মায় পর্যাপ্ত পানি না থাকায় শাখা নদীগুলোতে পানি কমে যায়। এতে নদী ও খালগুলোর স্বাভাবিক প্রবাহ বাধাগ্রস্ত হচ্ছে।"
রাজবাড়ীর নদীগুলোতে পানি প্রবাহ বজায় রাখার জন্য প্রয়োজন সঠিক পরিকল্পনা ও উদ্যোগ। ভূগর্ভস্থ পানির ওপর নির্ভরশীলতা কমাতে নদী ও খাল সংরক্ষণ, জলাধার পুনরুদ্ধার এবং সচেতনতার মাধ্যমে পানির টেকসই ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করতে হবে। অন্যথায় কৃষি খাতসহ পুরো অঞ্চলের পরিবেশ ও জনজীবনে ভয়াবহ প্রভাব পড়বে।
আমারবাঙলা/ইউকে