অমর একুশে বইমেলায় ‘সব্যসাচী’ প্রকাশনীর স্টলে হামলার ঘটনা তদন্তে সাত সদস্যের কমিটি গঠন করেছে বাংলা একাডেমি। কমিটিকে আগামী তিন কর্মদিবসের মধ্যে প্রতিবেদন দিতে বলা হয়েছে। এ ছাড়া এ হামলার কঠোর নিন্দা জানিয়েছেন প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস।
বইমেলায় যে আক্রমণ হয়েছে, তা মতপ্রকাশের ওপর আঘাত বলে মনে করে দেশের ১২৪ জন লেখক-শিল্পী-অধিকারকর্মী। তারা মঙ্গলবার (১১ ফেব্রুয়ারি) গণমাধ্যমে পাঠানো এক বিবৃতিতে মেলার নিরাপত্তা জোরদার করা ও আক্রমণকারীদের গ্রেপ্তারের দাবি জানিয়েছেন।
এদিকে মঙ্গলবার সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বাংলা একাডেমি সব্যসাচী স্টলের সংঘটিত ঘটনাকে অনভিপ্রেত হিসেবে তুলে ধরে এটির সুষ্ঠু তদন্তের জন্য কমিটি গঠনের কথা বলেছে। কমিটির আহ্বায়ক করা হয়েছে বাংলা একাডেমির পরিচালক (চলতি দায়িত্ব) মোহাম্মদ হারুন রশিদকে।
কমিটির অন্য সদস্যার হলেন- ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকল্যাণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক মো. রবিউল ইসলাম, সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের উপসচিব মোহাম্মদ খালিদ হোসেন, সৃংস্কৃতি কর্মী মোহাম্মদ রোমেল, বাংলাদেশ পুস্তক প্রকাশক ও বিক্রেতা সমিতির প্রতিনিধি মো. আবুল বাশার ফিরোজ শেখ ও শাহবাগ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মোহাম্মদ খালিদ মনসুর।
একাডেমির প্রেসের ব্যবস্থাপক মোহাম্মদ খোরশেদ আলম সদস্য-সচিবের দায়িত্ব পালন করবেন।
তসলিমা নাসরিনের বই রাখায় মেলার দশম দিন গত সোমবার সন্ধ্যায় সোহরাওয়ার্দী উদ্যান প্রাঙ্গণে প্রকাশনা সংস্থা ‘সব্যসাচী’র স্টলে উত্তেজনাকর পরিস্থিতি তৈরি হয়। একদল লোক সেখানে হামলা চালায়। তারা স্টলটিতে গিয়ে প্রকাশককে ঘিরে ধরে স্লোগান দিতে থাকলে পিরিস্থিতি সামাল দিতে পুলিশ সব্যসাচীর স্টলে বসা লেখক ও গীতিকার শতাব্দী ভবকে বইমেলায় তাদের নিয়ন্ত্রণ কক্ষে নিয়ে যায়।
পরে পুলিশের নিয়ন্ত্রণকক্ষও ঘিরে রাখে উত্তেজিত ওই ব্যক্তিরা। ঘটনার পর থেকে বন্ধ আছে সব্যসাচীর ১২৮ নম্বর স্টলটি। তবে বাংলা একাডেমি সোমবার সন্ধ্যায় সাংবাদিকদের বলেছে, বাংলা একাডেমি মেলায় কোনো স্টল বন্ধ করেনি এবং কোনো বইও নিষিদ্ধ করেনি।
হামলার নিন্দা প্রধান উপদেষ্টার, দোষীদের বিচারের আওতায় আনার নির্দেশ
সোমবার রাতে প্রথমে ইংরেজিতে পাঠানো এক বিবৃতিতে প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস বলেন, এই হামলা বাংলাদেশি নাগরিকদের অধিকার ও দেশের আইনের প্রতি অবজ্ঞা প্রদর্শন।
পরে বাংলায় পাঠানো প্রধান উপদেষ্টার বিবৃতিতে বলা হয়, একুশে বইমেলা এ দেশের লেখক ও পাঠকদের প্রাণের মেলা। এ দেশের সাহিত্যিক, প্রাবন্ধিক, চিন্তক, শিক্ষক-শিক্ষার্থীসহ সব শ্রেণি-পেশা-বয়সের মানুষের মিলনস্থল। বইমেলায় এই ধরনের অপ্রীতিকর ঘটনা বাংলাদেশের উন্মুক্ত সাংস্কৃতিকচর্চাকে ক্ষুণ্ন করে, ১৯৫২ সালের মহান ভাষা আন্দোলনের শহীদদের মর্যাদার প্রতি অবমাননা প্রদর্শন করে।
বিবৃতিতে বলা হয়েছে, অন্তর্বর্তী সরকার পুলিশ ও বাংলা একাডেমি কর্তৃপক্ষকে এ ঘটনার তদন্ত এবং দোষী ব্যক্তিদের বিচারের আওতায় আনার নির্দেশ দিয়েছে। মেলায় নিরাপত্তা জোরদার করতে এবং এই তাৎপর্যপূর্ণ স্থানে যেন কোনো অপ্রীতিকর ঘটনা না ঘটে, তা নিশ্চিত করতে পুলিশকে সব ধরনের ব্যবস্থা নিতে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
এ ছাড়া দেশে ‘মব ভায়োলেন্সের’ (দলবদ্ধ সহিংসতা) যেকোনো ঘটনা প্রতিরোধে জোরালো পদক্ষেপ নেওয়ার জন্য সংশ্লিষ্ট নিরাপত্তা সংস্থাগুলোকে নির্দেশ দিয়েছে অন্তর্বর্তী সরকার।
মতপ্রকাশের ওপর আঘাত, ১২৪ লেখক-শিল্পী-অধিকারকর্মীর বিবৃতি
মঙ্গলবার গণমাধ্যমে পাঠানো এক বিবৃতিতে বলা হয়, ফেসবুকে আগাম হুমকি দিয়ে সোমবার ‘সব্যসাচী’র স্টলে হামলা চালানো হয়েছে। এই মব (দলবদ্ধ বিশৃঙ্খলা) আক্রমণ মতপ্রকাশের স্বাধীনতার ওপর গুরুতর আঘাত। এই মবগোষ্ঠী দেশের জনগণের মৌলিক মানবাধিকার ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতার বিরোধী।
বিবৃতিতে বলা হয়েছে, এই আক্রমণ কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। ২০০৪ সালে লেখক হুমায়ুন আজাদের ওপর নৃশংস হামলা, ২০১৫ সালে লেখক অভিজিৎ রায় এবং প্রকাশক ফয়সাল আরেফিন দীপন হত্যাকাণ্ড থেকে সম্প্রতি মাজার ভাঙা, নারীদের ফুটবল খেলতে বাধা দেওয়া, বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম পরিবর্তনের সময় বেঁধে দেওয়া একই ধরনের সহিংসতার ধারাবাহিকতার অংশ। বিশেষত আওয়ামী ফ্যাসিবাদী শাসনামলে ভিন্ন চিন্তা ও বৈশিষ্ট্যের মানুষদের হত্যার ক্ষেত্রে প্রথমে উগ্রবাদী গোষ্ঠীর প্রচারণা ও সম্মতি উৎপাদন; পরবর্তী সময়ে সরকারের নিষ্ক্রিয়তা ও পরোক্ষ মদদে এসব হত্যার ঘটনা ঘটেছে। জুলাই অভ্যুত্থানের পরবর্তী সময়েও একইভাবে মতপ্রকাশের স্বাধীনতাকে বিপন্ন হতে দেখা যাচ্ছে।
বইমেলার বর্তমান নিরাপত্তাব্যবস্থা সম্পূর্ণ অকার্যকর উল্লেখ করে বিবৃতিতে বলা হয়, নিরাপত্তাব্যবস্থা তাৎক্ষণিকভাবে বহুগুণ জোরদার করতে হবে, প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ সব হামলাকারীকে দ্রুত গ্রেপ্তার করতে হবে। এ ধরনের কার্যকলাপ প্রতিরোধে আইনের যথাযথ প্রয়োগ করতে হবে। এই ন্যূনতম দাবিগুলোও পূরণ না হলে বাংলা একাডেমির বর্তমান মহাপরিচালক এবং সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের এই ব্যর্থতার দায় নিতে হবে।
বিবৃতিদাতাদের মধ্যে রয়েছেন গণতান্ত্রিক অধিকার কমিটির সদস্য ও অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক সামিনা লুৎফা, নৃবিজ্ঞানী নাসরিন খন্দকার, বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী জ্যোতির্ময় বড়ুয়া, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক গোলাম সারওয়ার, ইউনিভার্সিটি অব লিবারেল আর্টস বাংলাদেশের শিক্ষক লাবনী আশরাফি, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক মাসউদ ইমরান, বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক তুহিন ওয়াদুদ, লেখক ও গবেষক কল্লোল মোস্তফা, আইনজীবী মানজুর আল মতিন, মাওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী পরিষদের সাধারণ সম্পাদক হারুন উর রশীদ প্রমুখ।
আমারবাঙলা/এমআরইউ