কাজী নজরুল ইসলাম; বাংলাদেশের জাতীয় কবি। বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে তিনি ‘বিদ্রোহী কবি’ এবং আধুনিক বাংলা গানের জগতে ‘বুলবুল’ নামে খ্যাত। অবিভক্ত বাংলার সাহিত্য, সমাজ ও সংস্কৃতি ক্ষেত্রের অন্যতম শ্রেষ্ঠ ব্যক্তিত্ব তিনি। বিশ্ব সাহিত্যের বিস্ময়কর প্রতিভা নজরুল। মাত্র ২৩ বছরের সাহিত্যিক জীবনে তার সৃষ্টির প্রাচুর্য অভাবনীয়। এক হাতে তার বাঁশের বাঁশরি আর এক হাতে রণতূর্য ছিল।
নজরুল দ্রোহ, মানবতা, প্রেম, তারুণ্য ও পুনর্জাগরণের কবি। তার ছিল বিচিত্র জীবন। তিনি একাধারে কবি, গল্পকার, ঔপন্যাসিক, সংগীত রচয়িতা, সংগীতশিল্পী, সংগীত পরিচালক, অভিনেতা, সাংবাদিক ও স্বাধীনতা সংগ্রামী। বর্ণিল ও বর্ণাঢ্য সাহিত্য জীবনের মতো তার ব্যক্তিগত জীবনও তেমন। সাহিত্যের নানা শাখায় বিচরণ করলেও তার প্রধান পরিচয় তিনি কবি। কিন্তু বাকি পরিচয় থেকে তাকে মুছে ফেলার কোনো অবকাশ নেই।
বাংলা সাহিত্যে নজরুল নতুনত্বের স্রষ্টা। জাতি, ধর্ম, বর্ণ, লিঙ্গ, ভাষাভাষী-নির্বিশেষে সব মানুষের সমান অধিকারের জন্য নজরুল কথা বলেছেন। সারা দুনিয়ার নিপীড়িত মানুষের কণ্ঠস্বর তিনি। নজরুলের দুর্ভাগ্য যে তার কোনো সুযোগ্য সহযোগী ছিলেন না। অনুরাগী ছিলেন অগণিত। তার পরিবারেও কেউ ছিলেন না, যিনি নজরুলকে নিয়ে গবেষণা করবেন, গবেষকদের প্রয়োজনীয় উপকরণ দিয়ে সহায়তা করবেন। নজরুলের মতো আত্মভোলা ও অবৈষয়িক মানুষ এই গ্রহে খুব বেশি জন্মায়নি। তাই তার জীবন সম্পর্কে খুব বেশি জানা যায় না।
বলা চলে স্বাধীন বাংলায় নজরুল চর্চার প্রাসঙ্গিকতা বেড়েছে। তিনি বাঙালির শিল্প-সংস্কৃতি ও রাজনীতির কেন্দ্রীয় চরিত্র। নজরুল একইসঙ্গে প্রেমিক ও বিপ্লবী। ছোটবেলা থেকেই দুঃখের সঙ্গে যুদ্ধ করেছেন; তাই তার নাম দুখু মিয়া। তার জীবন শুরু হয়েছিল এক মিশ্র পরিবেশে। ২৪ মে ১৮৯৯ খ্রিষ্টাব্দে (১১ জ্যৈষ্ঠ ১৩০৬ বঙ্গাব্দ) ভারতের পশ্চিমবঙ্গের বর্ধমান জেলার আসানসোল মহকুমার চুরুলিয়া গ্রামের এক সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন তিনি। মাত্র নয় বছরে বাবা কাজী ফকির আহমদকে হারান নজরুল। বাবা ছিলেন মসজিদের ইমাম ও মাজারের খাদেম। পিতার মৃত্যুর পর পারিবারিক অভাব-অনটনের কারণে তার শিক্ষাজীবন বাধাগ্রস্ত হয়। মাত্র ১০ বছর বয়সে তাকে জীবিকা অর্জনের পথে হাঁটতে হয়।
শুরুতেই নজরুলের অসামান্য প্রতিভার পরিচয় পাওয়া যায়। মক্তব থেকে নিম্ন মাধ্যমিক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে মক্তবেই শিক্ষকতা শুরু করেন নজরুল। একই সঙ্গে কবরের সেবক ও মজজিদের মুয়াজ্জিন হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ফলে নজরুল অল্প বয়সেই ইসলামের মৌলিক আচার-অনুষ্ঠানের সাথে ঘনিষ্ঠভাবে পরিচিত হওয়ার সুযোগ পান। পরবর্তী সময়ে এসব তার সাহিত্যকর্মে প্রভাব ফেলে। মক্তব, মসজিদ ও মাজারের কাজে নজরুল বেশিদিন ছিলেন না। লোকশিল্পের প্রতি আকৃষ্ট হয়ে বালক নজরুল কবিতা, গান ও নৃত্যের মিশ্র আঙ্গিক চর্চার ভ্রাম্যমাণ নাট্যদল লেটোর দলে যোগ দেন। এখানেও তার চাচা কাজী বজলে করিমের প্রভাব ছিল। তিনি চুরুলিয়া অঞ্চলের লেটো দলের ওস্তাদ ছিলেন। আরবি, ফার্সি ও উর্দু ভাষায় তার দখল ছিল। বলা চলে লেটো দলেই নজরুলের সাহিত্যচর্চার শুরু। এই দলে তিনি অভিনয় করতেন, নাটকের জন্য গান ও কবিতা লিখতেন। ১৯১০ সালে নজরুল লেটো দল ছেড়ে ছাত্রজীবনে ফিরে আসেন। এই ছাত্রজীবন শুরুর দ্বিতীয় স্কুল মাথরুন উচ্চ ইংরেজি স্কুল যা পরবর্তী সময়ে নবীনচন্দ্র ইনস্টিটিউশন নামে পরিচিতি লাভ করে। এই স্কুলের প্রধান শিক্ষক ছিলেন কুমুদরঞ্জন মল্লিক, যিনি সেকালের বিখ্যাত কবি হিসেবে পরিচিত ছিলেন। তার সান্নিধ্যও নজরুলের প্রেরণার একটি উৎস।
কী বিচিত্র্য জীবন নজরুলের! সেখানেও তিনি বেশিদিন পড়াশোনা চালিয়ে যেতে পারেননি। আর্থিক সমস্যার কারণে তাকে আবার কর্মজীবনে প্রবেশ করতে হয়। বিভিন্ন কাজে যোগ দেওয়ার পর আসানসোলের চা-রুটির দোকানে রুটি বানানোর কাজ নেন নজরুল। দোকানে কাজের ফাঁকে নজরুল কবিতা ও ছড়া রচনা করতেন। ওই অঞ্চলের দারোগা রফিজউল্লাহ নজরুলের প্রতিভার পরিচয় পেয়ে ১৯১৪ খ্রিষ্টাব্দে তাকে ময়মনসিংহের ত্রিশালের দরিরামপুর স্কুলে সপ্তম শ্রেণিতে ভর্তি করে দেন। ১৯১৭ খ্রিষ্টাব্দের শেষদিকে নজরুল মাধ্যমিকের প্রি-টেস্ট পরীক্ষা না দিয়ে সেনাবাহিনীতে সৈনিক হিসেবে যোগ দেন। তিনি সেনাবাহিনীতে ছিলেন আড়াই বছর। এই সময়ের মধ্যে তিনি ৪৯ বেঙ্গল রেজিমেন্টের সাধারণ সৈনিক করপোরাল থেকে কোয়ার্টার মাস্টার হাবিলদার পর্যন্ত হয়েছিলেন। রেজিমেন্টের পাঞ্জাবি মৌলবীর কাছে নজরুল ফার্সি ভাষা শিখেন। বলা চলে নজরুলের সাহিত্যচর্চার হাতেখড়ি করাচি সেনানিবাসে। ওই সময় তার হাতে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় ও ফার্সি কবি হাফিজের কিছু বই আসে। সৈনিক থাকাকালে নজরুল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে অংশ নেন। ১৯২০ সালে বিশ্বযুদ্ধ শেষ হলে রেজিমেন্ট ভেঙে দেওয়া হয়। নজরুল সৈনিক জীবন ত্যাগ করে কলকাতায় ফিরে আসেন। শুরু হয় নজরুলের সাংবাদিক জীবন।
নজরুল ৩২ নম্বর কলেজ স্ট্রিটে বঙ্গীয় মুসলিম সাহিত্য সমিতির অফিসে বসবাস শুরু করেন। এখান থেকেই নজরুলের সাহিত্য-সাংবাদিকতা জীবনের মূল কাজগুলো শুরু হয়। প্রকাশিত অনেক লেখা প্রশংসিত হয়। কবি ও সমালোচক মোহিতলাল মজুমদার মোসলেম ভারত পত্রিকায় নজরুলের প্রকাশিত দুটি কবিতার প্রশংসা করে প্রবন্ধ লিখেন। এভাবেই অনেক বিদগ্ধ সাহিত্যিক-কবির সঙ্গে নজরুলের পরিচয় ঘটে। ১৯২১ সালে নজরুল শান্তি নিকেতনে গিয়ে রবীন্দ্রনাথের সাথে সাক্ষাৎ করেন। তখন থেকে মৃত্যু পর্যন্ত রবীন্দ্রনাথের সাথে নজরুলের সুসম্পর্ক ছিল। যদিও বোকা অনুসারীরা তাদের দুজনের মাঝে বিভেদ গড়ে! একটি সময় কাজী মোতাহের হোসেনের সাথে নজরুলের বিশেষ বন্ধুত্ব হয়। ১৯২০ খ্রিষ্টাব্দে নবযুগ নামে একটি সান্ধ্য দৈনিক পত্রিকা প্রকাশিত হয়। অসহযোগ ও খিলাফত আন্দোলনের প্রেক্ষাপটে প্রকাশিত এই পত্রিকার সম্পাদক ছিলেন শেরে-বাংলা এ. কে. ফজলুল হক। এই পত্রিকার মাধ্যমেই নজরুল নিয়মিত সাংবাদিকতা শুরু করেন। এই বছরই নজরুল একটি প্রবন্ধ লিখেন পত্রিকাটিতে; যার জন্য পত্রিকার জামানত বাজেয়াপ্ত করা হয় এবং নজরুলের ওপর পুলিশের নজরদারি শুরু হয়।
১৯২১ খ্রিষ্টাব্দের এপ্রিল-জুন মাসের দিকে নজরুল মুসলিম সাহিত্য সমিতির অফিসে গ্রন্থ প্রকাশক আলী আকবর খানের সাথে পরিচিত হন। তার সাথেই প্রথম কুমিল্লার বিরাজসুন্দরী দেবীর বাড়িতে আসেন। এখানেই পরিচিত হন প্রমীলা দেবীর সঙ্গে; যার সাথে নজরুলের প্রথম প্রণয় ও পরে বিয়ে হয়। এর আগে নজরুলের বিয়ে ঠিক হয় আলী আকবর খানের ভগ্নি নার্গিস আসার খানমের সঙ্গে। বিয়ের আখত শেষ হওয়ার পর কাবিনে নজরুলের ঘর জামাই থাকার শর্ত নিয়ে বিরোধ বাধে। নজরুল ঘর জামাই থাকতে অস্বীকৃতি জানান এবং বাসর শেষ হওয়ার আগেই নার্গিসকে রেখে বিরজাসুন্দরী দেবীর বাড়িতে চলে যান।
তখন নজরুল অনেক অসুস্থ ছিলেন। প্রমীলা দেবী নজরুলের পরিচর্যা করেন। এক পর্যায়ে তারা বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। নজরুল কুমিল্লায় থাকাকালীন দেশজুড়ে অসহযোগ আন্দোলন বিপুল উদ্দীপনার সৃষ্টি করে। ওই সময় নজরুল পরিণত হন একজন সক্রীয় রাজনৈতিক কর্মীতে। তার মূল কাজ ছিল শোভাযাত্রা ও সভায় যোগ দিয়ে গান গাওয়া। ১৯২১ খ্রিষ্টাব্দের নভেম্বর মাসে নজরুল আবার কুমিল্লায় ফিরে যান। নজরুলের ওই সময়ের কবিতা, গান ও প্রবন্ধের মাঝে বিদ্রোহের ভাব প্রকাশিত হয়। ১৯২২ খ্রিষ্টাব্দে বিদ্রোহী কবিতা প্রকাশিত হয়। ভারতজুড়ে কবিতাটি ব্যাপক সামাদৃত হয়। ওই বছরই নজরুল ধূমকেতু পত্রিকা প্রকাশ করেন। ১৯২০-এর দশকে অসহযোগ ও খিলাফত আন্দোলন একসময় ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়। এর পরপর স্বরাজ গঠনে যে সশস্ত্র বিপ্লববাদের অবির্ভাব ঘটে, তাতে ধূমকেতুর বিশেষ অবদান ছিল। পত্রিকার ২৬ সেপ্টেম্বর ১৯২২ সংখ্যায় নজরুলের কবিতা আনন্দময়ীর আগমণে প্রকাশিত হয়। এই রাজনৈতিক কবিতা প্রকাশের জন্য পত্রিকার ওই সংখ্যাটি নিষিদ্ধ হয়। একই বছরের ২৩ নভেম্বর তার যুগবাণী প্রবন্ধগ্রন্থ বাজেয়াপ্ত করা হয়। একই দিন তাকে কুমিল্লা থেকে গ্রেপ্তার করা হয়। পরে তাকে কলকাতায় নেওয়া হয়। ১৯২৩ খ্রিষ্টাব্দের ৭ জানুয়ারি নজরুল বিচারাধীন বন্দি হিসেবে আত্মপক্ষ সমর্থন করে এক জবানবন্দি দেন। তার এই জবানবন্দি বাংলা সাহিত্যে রাজবন্দির জবানবন্দি নামে বিশেষ সাহিত্যিক মর্যাদা লাভ করে। বিচারের পর নজরুলকে এক বছরের সশ্রম কারাদণ্ড দেওয়া হয়।
১৯৪২ খ্রিষ্টাব্দে নজরুল অসুস্থ হয়ে পড়েন। তিনি বাক্শক্তি হারিয়ে ফেলেন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের কারণে উন্নত চিকিৎসার জন্য তাকে দেশের বাইরে পাঠানো যায়নি। ১৯৪২ খ্রিষ্টাব্দের শেষের দিকে তিনি মানসিক ভারসাম্য হারান। ওই সময়ে নজরুল পরিবার ভারতে নিভৃত সময় কাটাতে থাকে। ১৯৫২ খ্রিষ্টাব্দে কবি ও কবিপত্নীকে রাঁচির এক মানসিক হাসপাতালে পাঠানো হয়। চার মাস কবি রাঁচিতে ছিলেন। ১৯৫৩ খ্রিষ্টাব্দের মে মাসে নজরুল ও প্রমীলা দেবীকে লন্ডন পাঠানো হয়। চিকিৎসকদের একদল জানান, ইনভল্যুশনাল সাইকোসিস রোগে ভুগছেন কবি। একটি এক্স-রে করানোর পর দেখা যায়, কবির মস্তিষ্কের ফ্রন্টাল লোব সংকুচিত হয়ে গেছে। পরে আরো অনেক গবেষণা শেষে সব চিকিৎসক নিশ্চিত হন, কবির আরোগ্য সম্ভব নয় এবং অস্ত্রোপচার ঝুঁকিপূর্ণ।
১৯৭১ খ্রিষ্টাব্দে বাংলাদেশ স্বাধীনতা লাভ করে। পরের বছর ২৪ মে ভারত সরকারের অনুমতিক্রমে নজরুলকে সপরিবারে বাংলাদেশ নিয়ে আসা হয়। তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবুর রহমান এক্ষেত্রে বিশেষ উদ্যোগ নিয়েছিলেন। বাংলা সাহিত্য ও সংস্কৃতিতে কবির বিশেষ অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ ১৯৭৪ খ্রিষ্টাব্দের ৯ ডিসেম্বর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিশেষ সমাবর্তনে নজরুলকে সম্মানসূচক ডিলিট উপাধিতে ভূষিত করা হয়। ১৯৭৬ খ্রিষ্টাব্দের জানুয়ারি মাসে কবিকে বাংলাদেশের নাগরিকত্ব দেওয়া হয়। একই বছরে নজরুলকে একুশে পদকে ভূষিত করা হয়। ২৯ আগস্ট ১৯৭৬ খ্রিষ্টাব্দ (১২ ভাদ্র ১৩৮৩) ঢাকার তৎকালীন পিজি হাসপাতালে কবি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। গানের কথায় কবির ইচ্ছাকে বিবেচনা করে তাকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় মসজিদের পাশে সমাধিস্থ করা হয়।
যদিও প্রমীলা দেবীর শেষ ইচ্ছা ছিল তার স্বামীকে চুরুলিয়ায় নজরুলের পৈতৃক বাড়িতে যেন তার কবরের পাশে সমাধিস্থ করা হয়। এভাবেই শেষ হয় একটি বর্ণিল ও বর্ণাঢ্য কবি ও আত্মভোলা জীবন। তার মতো বিদ্রোহ কিংবা দ্রোহ কেউ করতে পেরেছে বলে জানা নেই।
আমার বাঙলা/আরইউ