খুলনা সিটি করপোরেশনের (কেসিসি) ৪ নম্বর ওয়ার্ডের সদ্য সাবেক কাউন্সিলর গোলাম রব্বানী টিপু খুনের ঘটনায় হত্যা মামলা দায়ের হয়েছে।
শুক্রবার (১০ জানুয়ারি) দুপুরে নিহতের ভগ্নিপতি মো. ইউনুস আলী সেখ বাদী হয়ে কক্সবাজার সদর মডেল থানায় অজ্ঞাতনামাদের বিরুদ্ধে মামলাটি (নম্বর-১৮/১৮-২০২৫) দায়ের করেছেন বলে জানিয়েছেন থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) ইলিয়াছ খান।
এদিকে বৃহস্পতিবার রব্বানী, ইফতেখার এবং রুমি নামে এক নারী একইসঙ্গে কলাতলীর হোটেল গোল্ডেন হিলে কক্ষ বুক করেন বলে প্রচার পায়। তবে তারা একসঙ্গে হোটেলে ওঠেননি। কক্ষ বুকিংয়ের সময় রব্বানী তাদের তিনজনের পরিচয় দেন বলে হোটেল কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে। হোটেলের সিসিটিভি ফুটেজে মাস্ক পরা এক নারীকে রব্বানীর সঙ্গে হোটেল থেকে বের হতে দেখা যায়।
রুমি খুলনা মেডিক্যাল কলেজের শিক্ষার্থী বলেও প্রচার পেয়েছে। ঘটনার পর থেকে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী রব্বানীর সঙ্গে বের হওয়া রুমি নামে ওই নারীকে খুঁজছে। হত্যার পর রাত ১টার দিকে র্যাব হোটেলের সিসিটিভি ফুটেজ সংগ্রহ করে বলে জানান র্যাব-১৫ কক্সবাজারের অধিনায়ক লে. কর্নেল এইচএম সাজ্জাদ হোসেন।
রব্বানীর বড় ভাই শিক্ষক গোলাম রসুল বলেন, ঘটনার পরপরই শৃঙ্খলাবাহিনী ঘটনাস্থলে গিয়ে হত্যার আলামত সংগ্রহের চেষ্টা চালায়। নিহত টিপুর সঙ্গে তার সহকর্মী সাবেক এক কাউন্সিলর কক্সবাজার যান এবং তারা একসঙ্গে একটি হোটেলে যান বলেও জানতে পারি। টিপু হত্যার ক্লু বের করার চেষ্টায় খুলনার সাবেক কাউন্সিলর শেখ হাসান ইফতেখার ও কক্সবাজার শহরের টেকপাড়ার নুরুল কবির ভুট্টোকে হেফাজতে নিয়েছে র্যাব-১৫।
এর আগে বৃহস্পতিবার রাত পৌনে নয়টার দিকে কক্সবাজার সমুদ্র সৈকতের সি’গাল পয়েন্টের ঝাউবনের পাশে অজ্ঞাত অস্ত্রধারীরা তাকে গুলি করে হত্যা করে। শুক্রবার বিকালে ময়নাতদন্ত শেষে মরদেহ নিয়ে খুলনার পথে রওয়ানা দেন স্বজনরা। কৌশলে কক্সবাজার এনে ভাড়াটে খুনি দিয়ে তাকে হত্যার অভিযোগ করেছে পরিবার।
শুক্রবার দুপুরে নথিভুক্ত হওয়া মামলার এজাহারে বাদী উল্লেখ করেন, ভিকটিম গোলাম রব্বানী টিপু (৫৫) আমার স্ত্রী নুরজাহান বেগম হ্যাপির আপন মেঝ ভাই। গোলাম রব্বানী টিপুর কক্সবাজার জেলায় পূর্বে চিংড়ি মাছের ঘেরের ব্যবসা ছিল। গত ৮ জানুয়ারি রাত ১১টার গ্রিনলাইন বাসে ঢাকা থেকে কক্সবাজারে বেড়াতে আসেন টিপু। বৃহস্পতিবার (৯ জানুয়ারি) দুপুর দেড়টার দিকে টিপুর সঙ্গে বোন হ্যাপির (বাদীর স্ত্রী) মোবাইল ফোনে যোগাযোগ হয় এবং কক্সবাজারে বেড়াতে আসার কথা জানান। পরবর্তীতে একই দিন রাত প্রায় ১০টার দিকে খুলনা দৌলতপুর থানা পুলিশের মাধ্যমে খবর পাই গোলাম রব্বানী টিপুকে কক্সবাজার পৌরসভার ১২ নং ওয়ার্ডের সুগন্ধা পয়েন্টস্থ হোটেল সি’গাল’র পশ্চিম পার্শ্বে ফুটপাতের ওপর অজ্ঞাত দুর্বৃত্তরা মাথায় গুলি করে পালিয়ে যায়।
তিনি আরো লেখেন, স্থানীয় লোকজন ভিকটিম টিপুকে গুলিবিদ্ধ অবস্থায় উদ্ধার করে কক্সবাজার সদর হাসপাতালে নিয়ে গেলে কর্তব্যরত চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন। কক্সবাজার সদর থানা পুলিশ মরদেহের সুরতহাল রিপোর্ট প্রস্তুতের পর মরদেহ মর্গে পাঠায়। শুক্রবার সকালে বাদী ও পরিবারের লোকজন মর্গে উপস্থিত হয়ে মরদেহ শনাক্ত ও হত্যার বিষয়ে স্থানীয় লোকজনদের কাছে বিস্তারিত জানতে পারেন। আমাদের ধারণা ৯ জানুয়ারি রাত অনুমান সোয়া ৮টা থেকে সাড়ে ৮টার মধ্যবর্তী সময়ে অজ্ঞাতনামা দুর্বৃত্তরা পূর্ব পরিকল্পিতভাবে গোলাম রব্বানী টিপুকে মাথায় গুলি করে খুন করে।
নিহত টিপু খুলনার দৌলতপুরের দেয়ানা উত্তরপাড়ার বাসিন্দা গোলাম কবিরের ছেলে। তিনি খুলনা সিটি করপোরেশনের ৪ নম্বর ওয়ার্ডের সাবেক কাউন্সিলর এবং খুলনা মহানগর স্বেচ্ছাসেবক লীগের সহ-সভাপতির পদে ছিলেন। গত ২৬ সেপ্টেম্বর দেশের ১২টি সিটি করপোরেশনের কাউন্সিলরদের সঙ্গে তাকেও অপসারণ করে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়। ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর থেকে তিনি আত্মগোপনে ছিলেন।
রব্বানীর বড় ভাই শিক্ষক গোলাম রসুল গণমাধ্যমকে বলেন, টিপু এখানকার একজন জনপ্রিয় কাউন্সিলর ছিল। জনপ্রিয়তা এত বেশি ছিল যে, সে জীবিত থাকলে এখানে আর কেউ কাউন্সিলর হতে পারবে না। ৮ জানুয়ারি ১৬ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর ইফতেখারসহ কয়েকজন রব্বানীকে টোপ দিয়ে কক্সবাজারে নিয়ে গেছেন বলে জেনেছি। ব্যবসা বা অন্য কোনো কথা বলে হয়তো নিয়ে যান। ওখানে আগে থেকেই শুটার সেট করা ছিল।
গোলাম রসুলের মতে, কাউন্সিলরদের সঙ্গে কাউন্সিলরদের সম্পর্ক থাকে। হয়তো কারো না কারো প্ররোচনায় বা ব্যবসায়িক কথা বা অন্য কোনো প্রয়োজনের কথা বলে টিপুকে নিয়ে গেছে। যাই হোক না কেন, হত্যাকাণ্ডের ঘটনা খুলনাকেন্দ্রিক। তার (রব্বানী) শত্রুরা তাকে হত্যা করিয়েছে। শত্রু কারা, সেটি আমি বলতে পারছি না।
টিপুকে রক্তাক্ত উদ্ধার করে হাসপাতালে নেওয়া অটোরিকশার চালক জানান, রাত পৌনে ৯টার দিকে সৈকতের সি’গাল পয়েন্টের কাঠের সাঁকোর পাশের ঝাউবনে হঠাৎ বিকট শব্দ হয়। অকস্মাৎ হওয়া এ আওয়াজ গুলির শব্দ বুঝতে পেরে অনেকে দিগ্বিদিক ছুটতে থাকেন। তারা দেখতে পান এক ব্যক্তিকে গুলি করে পালিয়েছে দুর্বৃত্তরা। ওই সময় গুলিবিদ্ধের চিৎকার শুনে এগিয়ে যান তিনি। পরে রক্তাক্ত অবস্থায় তাকে উদ্ধার করে হাসপাতালে নিয়ে গেলে কর্তব্যরত চিকিৎসক মৃত ঘোষণা করেন।
প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, কয়েকজন লোক মোটরসাইকেলে এসে তাকে কপালে গুলি করে পালিয়ে যায়। পরে ঘটনাস্থল থেকে গুলির খোসা উদ্ধার করেছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। পর্যাপ্ত লাইটিং না থাকায় গুলি করে পালিয়ে যাওয়াদের শনাক্ত করা সম্ভব হয়নি।
জেলা পুলিশের মুখপাত্র অতিরিক্ত পুলিশ সুপার জসিম উদ্দিন চৌধুরী বলেন, আমরা তদন্ত করছি। বিস্তারিত বেরিয়ে আসবে বলে আশা করছি। ময়নাতদন্তের পর মরদেহ স্বজনরা নিয়ে গেছেন বলে জানান তিনি।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ব্যাবসায়িক কাজে প্রায় কক্সবাজারে আসতেন টিপু। মহেশখালীর বিভিন্ন ব্যবসায়ীর সঙ্গে শেয়ারে লবণ চাষ ও চিংড়ি ঘেরের ব্যবসা করতেন তিনি। মেরিন ড্রাইভ সড়কে জমিও ছিল তার। কক্সবাজারের বিভিন্ন এলাকার মানুষের সঙ্গে টিপুর বেশ সখ্যতা ছিল। কক্সবাজারে এলে অবস্থান করতেন ঝাউতলার হোটেল সাগরগাঁওয়ে।
তবে সাগরগাঁও হোটেল কর্তৃপক্ষ জানায়, এক সময় তিনি পারমানেন্ট সাগরগাঁও হোটেলে থাকতেন। তবে ২০১৮ সালের পর থেকে আর থাকতেন না।
স্থানীয়দের মতে, মাথায় যেভাবে গুলি করা হয়েছে তাতে অনুমান করা যাচ্ছে পরিকল্পিতভাবে তাকে সৈকতে নিয়ে গিয়ে হত্যা করা হয়েছে।
পর্যটন সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ীদের মতে, সৈকতের বেলাভূমির তীর ঝাউবন এলাকা ও সড়কে পর্যাপ্ত লাইটিং না থাকার সুযোগটি কাজে লাগিয়েছে দুর্বৃত্তরা। একই সুযোগ কাজে লাগিয়ে এর আগেও এসব এলাকায় অস্ত্র, মাদক হস্তান্তর, ডাকাত ও ছিনতাইকারীরা জড়ো হওয়ার ঘটনা ঘটেছে। পুলিশ ও র্যাব একাধিকবার এ স্থান থেকে ডাকাত, ছিনতাইকারী ও অস্ত্র কারবারিকে অস্ত্রসহ গ্রেপ্তার করেছিল। বেলাভূমির বিভিন্ন অনুষঙ্গ ভাড়া দিয়ে বার্ষিক কয়েক কোটি টাকা ফান্ড পায় বিচ ম্যানেজমেন্ট কমিটি। এসব টাকায় বিচ এলাকায় পর্যাপ্ত লাইটিং ও পরিচ্ছন্ন চলাচলের পথ সৃষ্টি এবং সৌন্দর্য বর্ধনের কাজ করা যায়। কিন্তু কমিটির ফান্ড তছরুপ করে বিচ এলাকাটাকে অনিরাপদ করে রাখা হয়। এতে পর্যটনের সমূহ ক্ষতি হচ্ছে বলে মনে করছেন পর্যটন সংশ্লিষ্টরা।
আমারবাঙলা/এমআরইউ