জেলা প্রতিনিধি : বন্যাপ্লাবিত ভাটির জনপদ সুনামগঞ্জের একদিকে পাহাড়ী ঢল অন্যদিকে উজানেও বৃষ্টি ভাটিতেও বৃষ্টি। ঢল ও ভারী বৃষ্টিপাতে সৃষ্ট বন্যার পানিতে জনজীবন বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে। প্রতিদিন নতুন নতুন এলাকা প্লাবিত হচ্ছে। ঘরবন্দি লোকজনের আর্তনাদ বাড়ছে।
বন্যার পানিতে ভেসে গেছে খামারের মাছ ও হাঁস। আমন, আউশ, ইরি ধানি জমি পানির নীচে। নলকুপ নিমজ্জিত থাকায় বিশুদ্ধ পানির সংকট দেখা দিয়েছে। গো-খাদ্যের অভাবে বিপাকে পড়েছেন কৃষক। ব্যবসা প্রতিষ্ঠান থেকে শুরু করে শিক্ষাঙ্গন, মসজিদ, মন্দির ও কবরস্থান প্লাবিত হয়ে ব্যাপক ক্ষতি ও ভোগান্তি পোহাতে হচ্ছে বন্যার্তদেরকে। রাস্তাঘাটের পাশাপাশি বাসাবাড়িতে পানি প্রবেশ করে দুর্ভোগ আরও বেড়েছে। অনেক জায়গায় চুলা-নলকূপও ডুবেছে। বন্যায় পানিবন্দি অবস্থায় মানবেতর জীবন যাপন করছেন জেলার ৬ লক্ষাধিক মানুষ।
এ রিপোর্ট লেখা পর্যন্ত জানা যায়, বৃহস্পতিবার (২০ জুন) ভোর পর্যন্ত জেলার প্রধান নদী সুরমা,কালনী,কুশিয়ারা ও যাদুকাটা নদীর পানি বিপদসীমার উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। তবে পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো) জানিয়েছে বুধবার বিকেল ২টা থেকে রাত ১২টা পর্যন্ত পানি স্থির রয়েছে।
প্রথম দিকে জেলার ৩টি উপজেলা বন্যা কবলিত হলেও এখন সারা জেলার ১২টি উপজেলা ঢলের পানিতে প্লাবিত হচ্ছে। হাওর এলাকায় খবর নিয়ে জানা গেছে, দিনে মাঝে মাঝে বৃষ্টি বন্ধ হলেও মুহুর্তেই কালো হয়ে উঠে আকাশ। নামে অবিরাম বর্ষণ এবং বর্ষণের সাথে শুরু হয় গর্জন। ভোগান্তি আর আতংক এখন সুনামগঞ্জবাসীর নিত্য সঙ্গী। একটানা ৪ দিন ধরে পাহাড়ী ঢলের সাথে লড়াই করে চলছেন বানভাসিরা। পানিবন্দি হয়ে পড়ায় অনেকেই বাসা বাড়ী ছেড়ে দিয়েছেন। আবার অনেকেই আশ্রয় কেন্দ্রে ঠাঁই নিয়েছেন।
সুগতনামগঞ্জ সদর উপজেলার ইব্রাহিমপুর গ্রামের দিনমজুর ইব্রাহিমপুর মিয়া বলেন,২০২২ সালের ১৭ জুন শুক্রবার সাড়ে ১২টায় ইব্রাহিমপুর সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয় আশ্রয়কেন্দ্রে অনাহারে মারা যান আমার পিতা জারীগানের শিল্পী মো.আশরাফ আলী। বন্যার পানিতে লাশ বেধে রাখা অবস্থায় ৬দিন পর কবরস্থানের মাটি জলমুক্ত হলে আমার বাবার লাশ দাফন করি। এবারও আমাদের সেই বসতঘরটি সোমবার (১৭ জুন) পবিত্র ঈদুল আযহার দিনে প্রথম দফার বন্যার পানিতে ডুবে যায়। আমরা স্বপরিবারে আশ্রয় নিয়েছি আমাদের বোন সুরমা ইউপি সদস্যা তানজিনা বেগমের বসতঘরে।
বুধবার (১৯ জুন) দিনব্যাপী সুনামগঞ্জ কারিগরী প্রশিক্ষণ কেন্দ্র ও জেলা আনসার ভিডিপি কার্যালয় আশ্রয়কেন্দ্র ছাড়াও সদর ও বিশ্বম্ভরপুর উপজেলার বেশ কয়েকটি আশ্রয়কেওন্দ্রে শুকনো খাবারসহ ত্রাণসামগ্রী বিতরণ করেছেন সুনামগঞ্জ ৪ (সদর বিশ্বম্ভরপুর) আসনের সংসদ সদস্য ড.মোহাম্মদ সাদিক ও জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ রাশেদ ইকবাল চৌধুরী। এসময় অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (সার্বিক) মো.রেজাউল করিম, অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (রাজস্ব) ছাব্বির আহমেদ আকুঞ্জি, সদর উপজেলা নির্বাহী অফিসার মৌসুমী মান্নান, বিশ্বম্ভরপুর উপজেলা নির্বাহী অফিসার মো.মফিজুর রহমান, কারিগরী প্রশিক্ষণ কেন্দ্রের অধ্যক্ষ মো.আব্দুর রব ও উপজেলা আওয়ামী লীগ সভাপতি হাজী আবুল কালামসহ স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরা উপস্থিত ছিলেন। অন্যদিকে উপজেলা প্রশাসন ও পুলিশ প্রশাসনের যৌথ উদ্যোগে ছাতক উপজেলার জামুরা সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়,ইসলামপুর উচ্চ বিদ্যালয়,দোয়ারাবাজার উপজেলার সুরমা ইউনিয়নের শরীফপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ও টেকনিক্যাল স্কুল এন্ড কলেজ আশ্রয়কেন্দ্রে ৫ হাজার পরিবারের মাঝে পুলিশ প্রশাসনের প্রস্তুতকৃত রান্না করা খাবার বিতরণসহ ত্রাণসামগ্রী প্রদান করেছেন সুনামগঞ্জ ৫ আসনের সংসদ সদস্য এম মুহিবুর রহমান মানিক।
এ সময় সহকারি পুলিশ সুপার (ছাতক ও দোয়ারাবাজার) সার্কেল রনজয় চন্দ্র মল্লিক,ছাতক উপজেলা চেয়ারম্যান রফিকুল ইসলাম কিরণ,পৌরসভার প্যানেল মেয়র তাপস চৌধুরী,দোয়ারাবাজার উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান দেওয়ান তানভীর আশরাফী চৌধুরী বাবু,দোয়ারাবাজার উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা নেহের নিগার তনু, দোয়ারাবাজার থানা ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) বদরুল হাসান ও ছাতক থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) মোহাম্মদ শাহ আলমসহ স্থানীয় গণ্যমান্য ব্যক্তিবর্গরা উপস্থিত ছিলেন।
বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট) এর পানিসম্পদ প্রকৌশল বিভাগের (ডব্লিউআরই) একটি ক্লাসে ড. তারেক বলেছিলেন,সিলেটের বন্যার কারণ ইটনা-মিঠামাইন সড়ক। এ সড়ক নির্মাণে কোন হাইড্রোলজিক্যাল সার্ভে হয়নি। বৃহদাকার কোন নির্মাণ প্রজেক্ট করার আগে নদীর পানি প্রবাহ,পানির উৎস,বৃষ্টির পানি,হাওরের পানির উপর এর কি প্রভাব পড়বে এসব সার্ভে করতে হয় উল্লেখ করে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সুনামগঞ্জের সিভিল সোসাইটির শত শত লোকজন দাবী করেন,জেলার বারংবারের বন্যার প্রধান অন্তরায় হচ্ছে ২৯ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যের এ ইটনা-মিঠামাইন সড়কটি। যার প্রবল বাধার কারণে জেলার প্রধান নদী সুরমা কালনী ও কুশিয়ারার পানি মেঘনা নদীতে প্রবাহিত হতে পারেনা।
সুনামগঞ্জ পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী মো.মামুন হাওলাদার বলেন, আজ বৃহস্পতিবার সকাল ৬টায় সুনামগঞ্জের ষোলঘর পয়েন্টে সুরমা নদীর পানি বিপদসীমার ৪১ সেন্টিমিটার ছাতক উপজেলায় ১৪০ সেন্টিমিটার উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। আগামী ৪৮ ঘন্টায় ভারতের মেঘালয়,আসাম ও ছেরাপুঞ্জিসহ সীমান্তে ভারি বৃষ্টিপাতের সম্ভবনা রয়েছে। এতে সুনামগঞ্জ জেলায় বন্যা পরিস্থিতি আরও অবনতি হতে পারে।
বন্যা পরিস্থিতি মোকাবেলায় জেলা প্রশাসন কর্তৃক পরিচালিত কন্ট্রোলরুমের দায়িতপ্রাপ্ত নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট মোস্তাফিজুর রহমান ইমন বাংলাদেশ সংবাদ সংস্থা বাসসকে বলেন, জেলার ১১টি উপজেলায় ৬ লাখ লোক পানিবন্দী রয়েছেন। জেলার ৫৪১টি আশ্রয়কেন্দ্রে ১৮ হাজার বন্যার্ত ভিকটিম আশ্রয় নিয়েছেন। এ পর্যন্ত বরাদ্দ রয়েছে জিআর ৫০০ মেট্রিক টন চাল ও জিআর ক্যাশ হিসেবে ৩৫ লাখ টাকা।
সুনামগঞ্জ জনস্বাস্থ্য প্রকৌশলী অধিদপ্তরের নির্বাহী প্রকৌশলী সৈয়দ খালেদুল ইসলাম বলেন, বন্যা মোকাবিলায় আমাদের যথেষ্ট প্রস্তুতি রয়েছে। এরই মধ্যে বন্যাকবলিত উপজেলাগুলোতে পানি বিশুদ্ধকরণ সাড়ে তিন লাখ ট্যাবলেট বিতরণ করা হয়েছে।
এছাড়াও পানি বিশুদ্ধ করন মোবাইল ওয়াটার ট্রিটম্যান্ট প্ল্যান্ট এর আওতায় প্রতিটি গাড়িতে ৬ হাজার লিটার করে ২ টি গাড়িতে ১২ হাজার বিশুদ্ধ পানি এবং ১৪ লাখ পানি বিশুদ্ধ করন ট্যাবলেট প্রস্তুত রয়েছে। এ দিকে কয়েক হাজার নলকুপ পানিতে নিমজ্জিত হয়ে প্রায় ৩ হাজার নলকুপ নষ্ট হয়েছে।
সুনামগঞ্জ কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক বিমল চন্দ্র সোম জানান, অতি বৃষ্টি ও পাহাড়ি ঢলে জেলায় ১ হজার ৬ শত ৭৭ হেক্টর আউশ ধান ও ৪ শত ১৩ হেক্টর সবজি বন্যার পানিতে ডুবে গেছে। তিনি বলেন,উপজেলাওয়ারী ক্ষয়ক্ষতির পরিমান নির্ণয় করতে ২/৩ দিন সময় লাগবে।
সুনামগঞ্জ জেলা প্রাণী সম্পদ অফিসার ডা. মো. রফিকুল ইসলাম বলেন,জেলার গবাদি পশু ও হাঁস মুরগির মৃত্যু ও ক্ষয় ক্ষতির পরিমাণ এখনও নির্ধারণ করা সম্ভব হয়নি। তবে ধারনা করা হচ্ছে ১২ উপজেলায় প্রচুর গোখাদ্য বন্যার পানিতে ভেসে গেছে।
সুনামগঞ্জ সদর উপজেলা সহকারী কমিশনার (ভূমি) মো. এমদাদুল হক শরীফ বলেন, চলমান বন্যা পরিস্থিতিতে নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যমূল্যের বাজার মনিটরিং অব্যাহত আছে। কোন অসাধু ব্যবসায়ী কিংবা চক্র নিত্য প্রয়োজনীয় যেকোন দ্রব্যের দাম বৃদ্ধি করলে বা করার চেষ্টা করলে তাৎক্ষণিকভাবে তাকে শাস্তি প্রদানের আওতায় আনা হচ্ছে।
জেলা মৎস্য অফিসার মোঃ শামশুল করিম বলেন, দোয়ারাবাজার, ছাতক ও সদর উপজেলায় প্রায় ৫০০ পুকুরের মাছ ভেসে গেছে। এতে ক্ষতির মুখে পড়েছেন মাছচাষিরা। অন্যান্য উপজেলার ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ জানানোর জন্য উপজেলা মৎস্য অফিসারদের নির্দেশ দিয়েছি।
সুনামগঞ্জ জেলা প্রশাসক মো.রাশেদ ইকবাল চৌধুরী বলেন, পাহাড়ি ঢল ও অতি বৃষ্টিতে সুনামগঞ্জের সুরমা নদী তীরবর্তী নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হয়েছে। এতে কয়েক লক্ষাধিক মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েন। ইতিমধ্যে যারা আশ্রয় কেন্দ্রে আশ্রয় নিয়েছেন তাদের জন্য ১০ মেট্রিকটন চাল এবং ২ লাখ ৫০ হাজার টাকা ও শুকনো খাবার বরাদ্দসহ বন্টন করা হয়েছে। এছাড়াও পর্যাপ্ত মরিমাণ ত্রাণসামগ্রী মজুত আছে। জেলা প্রশাসন বন্যা মোকাবেলায় প্রস্তুত রয়েছে।
এবি/এইচএন