সিরাজগঞ্জের বেলকুচি উপজেলার ধুকুরিয়া বেড়ার পল্লী বিদ্যুতের গ্রাহক শামসুল হক। সুতা বুনে প্রতিবন্ধী মেয়েসহ ৩ সদস্যের সংসারের হাল ধরেছেন। পরিবারে নূন আনতে পান্তা ফুরানোর অবস্থায় হঠাৎই অস্বাভাবিক বিদ্যুৎ বিলের ফাঁদে পড়েন তাঁত শ্রমিক শামসুল হক। এক মাসেই বিল আসে ৪৬ লাখ টাকারও বেশি।
শামসুল হক বলেন, দুটি বাতি আর একটি ফ্যান চালিয়ে বিল আসে দেড়শো থেকে দুইশো টাকা। অথচ হঠাৎ এক মাসে বিল আসে ৪৬ লাখ টাকা। নিশ্চয় মিটারে সমস্যা ছিলো, না হলে এতো বিল কেন আসবে?
বিদ্যুতের মিটারে এমন অস্বাভাবিক বিলের বিষয়ে স্থানীয়রাও হতবাক বনে যান। তারা বলেন, একজন শ্রমিকের মিটারেতো এত বেশি বিল আসার কথা না। মিটার নিম্নমানের হওয়াই এমন অবস্থা।
মাস কয়েক আগে শামসুল হকের মিটারে এমন অস্বাভাবিক বিল আসলেও মিটারের অস্বাভাবিক আচরণ থেমে নেই। বেলকুচির অনেক গ্রাহকের মিটারের অবস্থা প্রায় একইরকম। তাদের অভিযোগ, বিদ্যুৎ সংযোগ বিচ্ছিন্ন থাকলেও মিটারে লাল বাতি জ্বলে, অনেক মিটারের ডিসপ্লে সাদা হয়ে যায়, হ্যাং হয়ে যায়, আবার আগের তুলনায় বিলও বেশি উঠে। গ্রাহকের টাকা দিয়ে নিম্নমানের মিটার কিনে সরবরাহ করা হচ্ছে বলে ক্ষোভ প্রকাশ করেন তারা। এসময় মানসম্মত মিটার সরবরাহের দাবি জানান গ্রাহকেরা।
সিরাজগঞ্জের উল্লাপাড়া উপজেলার ভট্টকাওয়াক গ্রামের বরাত মোল্লা বলেন, আগে ৩-৪টি লাইট জ্বালিয়ে বিল আসতো ৪'শ টাকার মতো, অথচ ডিসেম্বর মাসে দুটি লাইট জ্বালিয়ে বিল আসে ২ হাজার ৮০০ টাকা। এমন অস্বাভাবিক বিলের কারণে ত্রুটিপূর্ণ মিটার সরবরাহকেই দুষছেন কৃষক বরাত মোল্লা।
ত্রুটিপূর্ণ মিটার গলার কাঁটা হয়ে দাঁড়িয়েছে একই উপজেলার সোনাতলা গ্রামের সোহেল রানার পরিবারেও। তার অভিযোগ, দুটি লাইট ও একটি ফ্রিজ ব্যবহার করে গত মাসে বিল গুনতে হয়েছে ১ হাজার ৫০০ টাকা। অথচ গ্রীষ্মকালে বিল আসতো ৪ থেকে সাড়ে ৪'শ টাকা।
সিরাজগঞ্জের কয়েকটি এলাকায় সরেজমিনে ঘুরে বৈদ্যুতিক মিটারের এমন চিত্র দেখা গেছে। মিটারের এমন অস্বাভাবিক আচরণের কবলে জেলার অসংখ্য গ্রাহক। মিটারগুলোতে অটোপালস দেয়া, ডিসপ্লে সাদা হওয়া, সার্কিট নষ্ট হওয়া, পুড়ে যাওয়া, রিডিং উঠানামা করাসহ বেশকয়েকটি ত্রুটির বিষয় উঠে এসেছে।
সূত্র বলছে, বৈদ্যুতিক মিটার ক্রয় করে আরইবি বা পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ড। সেগুলো পল্লী বিদ্যুৎ সমিতিগুলোকে সরবরাহ করে আরইবি। পরে এসব মিটার গ্রাহক পর্যায়ে স্থাপন করে পল্লী বিদ্যুৎ সমিতি। সিরাজগঞ্জে মিটার নষ্টের হিড়িক পরায় ভোগান্তিতে পড়েছেন পল্লী বিদ্যুতের গ্রাহকেরা।
সিরাজগঞ্জ পল্লী বিদ্যুৎ সমিতি-১ এর ত্রুটিপূর্ণ মিটারের একটি প্রতিবেদন দ্যা নিউজের হাতে এসেছে। যেখানে ৫টি কোম্পানির মিটার নষ্টের বিষয়ে বলা হয়েছে। ৩ বছরে (২০২১-২০২৩) স্থাপন হওয়া মিটারগুলোর মধ্যে বি অ্যান্ড টি মিটার নষ্টের সংখ্যা ৩৮ হাজার ৬০৬টি। যা মোট মিটারের এক তৃতীয়াংশ। মেরামতের অনুপযোগী হওয়ায় মিটারগুলো বিনষ্ট করা হয়েছে বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়।
এ বিষয়ে বি অ্যান্ড টি মিটার কোম্পানির ব্যবস্থাপনা পরিচালক ইঞ্জিনিয়ার মোখলেছুর রহমানকে মিটার নষ্টের বিষয়ে প্রশ্ন করা হলে মুঠোফোনের সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেন। অন্য মিটার কোম্পানির কারো সাথে কথা বলা সম্ভব হয়নি।
এ বিষয়ে সিরাজগঞ্জ পল্লী বিদ্যুৎ সমিতি-১ এর জিএম জাকির হোসেন বলেন, যে অভিযোগগুলো আসছে, সেটি খুবই কম, যান্ত্রিক বিষয়ে এমন হতেই পারে।সিরাজগঞ্জ পল্লী বিদ্যুৎ সমিতি-২ এর সিনিয়র জিএম আবু আশরাফ মো. ছালেহ বলেন, মিটারে সমস্যা থাকলে কর্তৃপক্ষকে জানানো হয়। মিটার আমরা কিনি না, পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ড (আরইবি) থেকে বরাদ্দ পাই। যারা মিটার কেনেন, তাদের সাথে কথা বলেন।
পল্লী বিদ্যুৎ সমিতির নিয়ন্ত্রক সংস্থা পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ডের (আরইবি) পরিকল্পনা ও উন্নয়ন বিভাগের সদস্য বিশ্বনাথ শিকদার বলেন, মিটার ও অন্যান্য মালামাল নিয়ে তদন্ত কমিটি কাজ করছে, কমিটি সারা দেশ থেকে মিটার নষ্টের তথ্য সংগ্রহ করছে। কয়েক দিনের মধ্যেই প্রতিবেদন পাওয়া যাবে। তখন মিটার নষ্টের কারণ জানা যাবে। সব কোম্পানির মিটার যাচাই-বাছাই করে দেখা হবে। কমিটি এ বিষয়ে সুপারিশও করবে। সিরাজগঞ্জের মিটার নষ্টের বিষয়েও জিএমদের সাথে আমরা কথা বলবো।
আমারবাঙলা/এনআই