আজ রবিবার ঐতিহাসিক ১০ নভেম্বর, শহীদ নূর হোসেন দিবস। ১৯৮৭ সালের এই দিনে স্বৈরাচার এরশাদবিরোধী গণআন্দোলন চলাকালে রাজধানীর গুলিস্তানের জিরো পয়েন্ট এলাকায় (বর্তমান শহীদ নূর হোসেন চত্বর) পুলিশের গুলিতে শহীদ হন যুবলীগ নেতা ২৪ বছরের টগবগে যুবক নূর হোসেন। বুকে-পিঠে 'গণতন্ত্র মুক্তি পাক, স্বৈরাচার নিপাত যাক' লিখে বিক্ষোভ প্রদর্শনকালে পুলিশ তাকে গুলি করে। এরপর থেকে দিনটি 'গণতন্ত্র মুক্তি দিবস' হিসেবেও পালিত হয়ে আসছে।
বিএনপি দিনটি পালন করে আসছে ‘ঐতিহাসিক ১০ নভেম্বর দিবস’ হিসেবে। আর আওয়ামী লীগ দিনটি পালন করে ‘নূর হোসেন দিবস’ হিসেবে।
নূর হোসেন তৎকালীন স্বৈরাচার এরশাদবিরোধী আন্দোলনের নায়ক। যিনি জীবন্ত পোস্টার হয়ে গণতন্ত্রকামী মানুষের চিরন্তন আকাঙ্ক্ষাকে স্লোগানের অক্ষরে বুকে-পিঠে ধারণ করেছিলেন।
সেদিন রাজপথে মিছিল নিয়ে বের হয়েছিলেন ঢাকার বনগ্রামের এক অটোরিকশাচালকের ঘরে জন্ম নেওয়া নূর হোসেন। মিছিলটি পল্টন এলাকার ‘জিরো পয়েন্ট’ অতিক্রম করার সময় পুলিশ কাঁদানে গ্যাস ও গুলিতে নূর হোসেনসহ কয়েকজনের মৃত্যু হয়। নূরের সেদিনের আত্মত্যাগ মানুষের মনকে নাড়া দিয়েছিল। ওই আন্দোলনের ধারাবাহিকতায় আরো রক্তপাতের মধ্য দিয়ে ১৯৯০ সালের ৬ ডিসেম্বর হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদ ও তার সরকারের পতন ঘটে।
এরপর ১৯৯১ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারি বিচারপতি সাহাবুদ্দীন আহমদের অন্তর্বর্তী সরকারের অধীনে জাতীয় সংসদ নির্বাচনে সব দল অংশ নেয়। বিএনপি একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেয়ে সরকার গঠন করে।
শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর ঐতিহাসিক এই দিবসটিকে সামনে রেখে আওয়ামী লীগ গুলিস্তান জিরো পয়েন্টে নূর হোসেন চত্বরে কমর্সূচি ঘোষণা করেছে। ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর আওয়ামী লীগ সেভাবে প্রকাশ্যে কোনো কর্মসূচি পালন করছে না। তবে নূর হোসেন দিবস উপলক্ষে আজ রবিবার বেলা তিনটায় গুলিস্তানের জিরো পয়েন্টে নেতা-কর্মীদের জড়ো হয়ে মিছিল করার আহ্বান জানিয়েছে দলটি। আওয়ামী লীগের ফেসবুক পোস্ট দিয়ে এ কর্মসূচি ঘোষণা করা হয়।
তবে প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম এক ফেসবুক পোস্টে আওয়ামী লীগকে ফ্যাসিস্ট আখ্যা দিয়ে লিখেছেন, তারা আজ কোনো জমায়েত বা মিছিল করার চেষ্টা করলে আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলোর কঠোর অবস্থানের মুখোমুখি হতে হবে।
তবে আওয়ামী লীগের এই কর্মসূচির সমালোচনা করে বিভিন্ন রাজনৈতিক গোষ্ঠীর মতবাদ দেখা গেছে।
এই কর্মসূচিকে প্রতিহত করতে পাল্টা কর্মসূচির ঘোষণাও দিয়েছে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন। কর্মসূচির অংশ হিসেবে সাধারণ ছাত্র-জনতাকে ১০ নভেম্বর জিরো পয়েন্টে আসার আহ্বান জানান বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের অন্যতম সমন্বয়ক হাসনাত আবদুল্লাহ।
এদিকে আন্দোলনকে কেন্দ্র করে শনিবার (৯ নভেম্বর) দিবাগত রাত থেকেই গুলিস্তানে আওয়ামী লীগের দলীয় কার্যালয়ের সামনে বিক্ষোভ করেছেন ছাত্র-জনতা। এর আগে জিরো পয়েন্টে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার ব্যানারে বিক্ষোভ করেন বেশ কয়েকজন ব্যক্তি। রাত ১১টার দিকে তারা বিক্ষোভ শুরু করেন। এ সময় তারা ‘খুনি কেন বাহিরে, মুগ্ধ কেন কবরে,’ ‘নূর হোসেন দিচ্ছে ডাক, খুনি শেখ হাসিনা নিপাত যাক’— এমন বিভিন্ন স্লোগান দেন। শেখ হাসিনার বিচারের দাবি তোলেন তারা।
এ ছাড়া গুলিস্তানে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনে অবস্থান নিয়ে স্লোগান দিতে থাকেন বিএনপি ও এর অঙ্গসংগঠনের নেতা-কর্মীরা। পুলিশ তাদের কার্যালয়ের সামনে থেকে সরে যেতে অনুরোধ করে। পরে বিক্ষোভকারীরা অদূরে মুক্তিযোদ্ধা অফিসের সামনে গিয়ে অবস্থান নেন। বিএনপির দেড় শতাধিক নেতা-কর্মীকে সেখানে অবস্থান নিতে দেখা যায়।
বনগ্রামের মজিবুর রহমান ও গৃহিণী মরিয়ম বিবির সাত সন্তানের একজন নূর হোসেন। দরিদ্র পরিবারে এতগুলো ভাইবোন এক ঘরে থাকা কঠিন ছিল। মেজ ছেলে নূর তখন থাকতেন মতিঝিলের ডিআইটি বিল্ডিংয়ের পাশের মসজিদের এক ঘরে। লেখাপড়া খুব বেশি করেননি। অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত লেখাপড়া শেষে নূর হোসেন গাড়ি চালানোর প্রশিক্ষণ নেন। তবে মা মরিয়ম বললেন, ‘আমার ছেলে ইংরেজি শিখত নিজে নিজে। দিনের ঘটনা সব লিইখ্যা রাখত ডায়েরিতে। মারা যাওয়ার আগের রাতে আমার ছেলেটা যে কী লিখছিল, কোনো দিন জানতে পারলাম না। ডিআইটির মসজিদে থাকা ওর ডায়েরিটা সরায় ফেলানো হইছিল। তখন স্বৈরাচারের শাসনকাল। অনেক কিছুই সামনে আসতে দেয় নাই। ওর মুখটাই আর দেখি নাই।’
মরিয়ম বিবি জানালেন, ১৯৮৭ সালের ১০ নভেম্বর ভোরে ফজরের নামাজ আদায় করে বনগ্রামের বাসা থেকে নূরের বাবা আর তিনি ছুটেছিলেন মতিঝিলে। সেদিন সচিবালয় ঘেরাও করার কথা। মন বলছিল নূর মিছিলে যাবে, বিপদ হতে পারে। তারা গিয়েছিলেন ছেলেকে সাবধান করতে। মরিয়ম বিবি বলেন, ‘গিয়া দেখি ছেলে ঘুমাইতেছে। শরীরের মধ্যে কীসব যেন লেখা। আমাগো দেইখা একটা চাদর গায়ে জড়ায় সামনে আসছে। তখন বুঝি নাই আমার ছেলে জীবন্ত পোস্টার হইছে। অথচ ও আমারে বলছিল, মিছিলের সামনে যাইব না।’
আমারবাঙলা/এমআরইউ