কালের বিবর্তনে বাংলার মসলিন শিল্প হারিয়ে গেলেও স্বগর্বে টিকে আছে রংপুরের শতরঞ্জি শিল্প। ২০২১ সালে শতরঞ্জি বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার কাছ থেকে পেয়েছে জিআই পণ্য হিসেবে স্বীকৃতি।
বর্তমানে রংপুরের প্রায় ২০ হাজার নারী এই বুনন শিল্পে হয়েছেন স্বনির্ভর। অভ্যন্তরীণ বাজার ছাড়াও রপ্তানি হচ্ছে এশিয়া, ইউরোপ, আমেরিকাসহ বিশ্বের ৩৬টিরও বেশি দেশে। আর এই হস্তজাতশিল্প থেকে বছরে বৈদেশিক মুদ্রা আয় হচ্ছে প্রায় ৪০ লাখ মার্কিন ডলার।
রংপুর নগরীর পশ্চিমে ঘাঘট নদীর তীর ঘেঁষা নিশবেতগঞ্জ গ্রাম। গ্রামটি এই শিল্পের উর্বর ভূমি হিসেবেই পরিচিত। এখানে প্রতিটি কারখানায় খটখট শব্দে প্রতিদিন বোনা হয় ঐতিহ্যবাহী শতরঞ্জি। যন্ত্রের ব্যবহার ছাড়াই কেবল বাঁশ, কাঠ ও রশির মাধ্যমে পাট, সুতা কিংবা গার্মেন্টসের ঝুট দিয়ে হাতের ছোঁয়ায় তৈরি হয় শতরঞ্জি। এ ছাড়া নগরীর রবার্টসনগঞ্জে রয়েছে কারুপণ্য নামে শতরঞ্জির সুবিশাল কারখানা। পাশাপাশি জেলার সদর, বদরগঞ্জ ও তারগঞ্জে গড়ে উঠেছে আরো কিছু শতরঞ্জির কারখানা।
নগরীর নিশবেতগঞ্জের শতরঞ্জিপল্লিতে গিয়ে দেখা যায়, শত শত নারী শতরঞ্জি বুননে ব্যস্ত। শেফালি বেগম এক নারী শ্রমিক বললেন, ‘দীর্ঘ ২০ বছর থেকে কাজ করছি। দুইটা ছেলে মেয়েকে পড়াশোনা করানোর পাশাপাশি কিছু জমি জায়গাও কিনছি। এই শতরঞ্জির কাজ করে সংসারটা ভালোই চলে।’
রাশেদা বেগম আট বছর ধরে কাজ করছেন এই কারখানায়। তিনি বলেন, ‘শতরঞ্জি বুননের টাকায় যা আয় হয়, তা দিয়ে সংসার ভালোভাবেই চলছে। অর্ধেক টাকা ডিপিএস এ জমা করি আর বাকি টাকা দিয়ে সংসার চালাতে স্বামীকে সাহায্য করি।’
সুলতানা আক্তার, মাছুমা খাতুন, আছিয়া খাতুন, রঞ্জিনা বেগম, আজমিয়া বেগম, মৌসুমী বেগমসহ আরো অনেকেই বলেন, হস্তজাত এই শতরঞ্জিশিল্পের সঙ্গে জড়িয়ে তাদের জীবন-জীবিকা চলছে। প্রতিদিন একজন শ্রমিক ১০ থেকে ১৫ বর্গফুট শতরঞ্জি বুনতে পারেন। প্রতি বর্গফুটে তারা ১৫ টাকা করে মজুরি পেয়ে থাকেন।
পরিবর্তন এসেছে এর নকশাতেও। সাদা মাটার রূপ ঘুচিয়ে বর্তমানে শতরঞ্জি দারুণ বাহারি, বর্ণিল। আগে এর প্রধান উপকরণ ছিল পাট, বর্তমানে গার্মেন্টসের ঝুট থেকে সুতা তৈরি করে তা দিয়ে বানানো হচ্ছে শতরঞ্জি। নান্দনিক নকশা, বহুমুখী ব্যবহার, সাশ্রয়ী দাম ও পরিবেশবান্ধব হওয়ায় বিদেশেও জায়গা করে নিয়েছে এই শিল্প। তবে দক্ষ কারিগরের অভাবসহ আছে নানা প্রতিবন্ধকতা।
শতরঞ্জিপল্লির স্বত্বাধিকারী মনিরা বেগম বলেন, ‘এই শিল্পকে টিকিয়ে রাখার চেষ্টা করে যাচ্ছি। বর্তমানে দক্ষ কারিগরের বড্ড অভাব। বিসিক থেকে যে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয় তা একেবারে অপ্রতুল।’
তিনি বলেন, সরকার যদি এই শিল্পের প্রতি বাড়তি যত্ন নিয়ে বিশেষ পরিকল্পনা গ্রহণ করতো তাহলে এই শিল্পের আরো প্রসার ঘটতো।
চারুশী প্রতিষ্ঠানের স্বত্বাধিকারী তহুরা বেগম বলেন, ‘শতরঞ্জি রপ্তানিতে প্রতিবছর দেশে প্রায় ৪০ লাখ মার্কিন ডলার আয় হয়। কিন্তু এই শিল্পে সরকার যথোপযুক্ত গুরুত্ব দেয় না। এসএমই বা বিসিক সঠিকভাবে কাজ করে না। অথচ বিশেষ নজর দেওয়া গেলে এই শিল্পে আরো ব্যাপক কর্মসংস্থান বৃদ্ধি করা যেত।’
শতরঞ্জিসহ বিভিন্ন ধরনের হস্তজাত শিল্প প্রতিষ্ঠান আপনের ব্যবস্থাপনা পরিচালক অষিত চৌধুরী বলেন, ‘এসএমই ও বিসিক যে মেলাগুলো করে সেখানে হস্তশিল্পের আলাদা প্যাভিলিয়ন দেওয়ার পাশাপাশি যদি বিশেষ সুবিধা দেওয়া হতো তাহলে আমরা সহজেই অংশ নিয়ে এই শিল্পের আরো প্রসার ঘটাতে পারতাম। একইসঙ্গে আমরা যারা এই শিল্পের সঙ্গে যুক্ত তাদের প্রণোদনাসহ কম সুদে ঋণের ও কাঁচামালের সহজলভ্যতা করতো তাহলে এই শিল্পের প্রসার ঘটানোর পাশাপাশি বৈদেশিক মুদ্রার আয়ও বাড়ানো যেত।’
বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের সাইফুদ্দীন খালেদ বলেন, ‘জিআই স্বীকৃতি পাওয়া শতরঞ্জিকে নিয়ে প্রয়োজন বিশেষ পরিকল্পনা। যে পরিকল্পনার মাধ্যমে গ্রামীণ অশিক্ষিত, অর্ধশিক্ষিত বেকার নারী ও পুরুষদের প্রশিক্ষণ দিয়ে সল্প সুদে ঋণ প্রদান করা গেলে এই শিল্পের মাধ্যমে গ্রামীণ অর্থনীতির চাকা আরো গতিশীল করা সম্ভব।’
আমারবাঙলা/এমআরইউ