দর্পণ কবীর, নিউইয়র্কঃ বাংলাদেশে ফ্যাসিষ্ট সরকারের ১৫ বছরের সময়কালে যুক্তরাষ্ট্রে বসবাসরত কয়েক শত প্রবাসী বিপুল অর্থবিত্তের মালিক হয়েছেন। তারা সকলেই যুক্তরাষ্ট্র আওয়ামী লীগ ও অঙ্গ সংগঠনের বিভিন্ন স্তরের নেতা ও কর্মী। তাদের মধ্যে কয়েকজন ঈর্ষণীয় পরিমানের অর্থ পাচার করে যুক্তরাষ্ট্রে বিলাসী জীবন-যাপন করছেন। ফ্যাসিষ্ট শেখ হাসিনার সরকারের পতন হলে এই বাংলাদেশি-আমেরিকানরা ধূর্ততার সঙ্গে মার্কিন অভিবাসী সমাজে ফিরে এসেছেন। তারা বিপুল অর্থ-বিত্তের মালিক হওয়ায় সামাজিকভাবে নিজেদের অবস্থান অন্যস্তরে নিয়ে যেতে পেরেছেন। তবে তাদের বিত্ত-বৈভবের প্রসার দেখে সাধারণ প্রবাসীদের প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। অনেকরকম কথা চায়ের টেবিলে আলোচনা হচ্ছে। সাধারণ প্রবাসীদের প্রশ্নবাণ এড়াতে এই নব্য বিত্তশালীরা অনেকটা গা ঢাকা দিয়ে জীবনযাপন করছেন। অবশ্য তারা বসে নেই। জুলাই বিপ্লব পরবর্তী অন্তবর্তীকালীন সরকারের বিরুদ্ধে মার্কিন প্রশাসনে লবিং করার কাজে অর্থ ঢালছেন বলে জানা গেছে। সরকার বিরোধী মিথ্যাচার প্রচারণায় এই লুটেরারা ব্যস্ত। কয়েকজন লুটেররার রাতারাতি ‘বিত্তশালী’ হওয়ার তথ্য রিপোর্টে তুলে ধরা হল।
ফ্যাসিষ্ট সরকারের পৃষ্ঠপোষকতায় যে কজন বাংলাদেশি-আমেরিকান সবচেয়ে বেশি অর্থ হাতিয়েছেন তাদের মধ্যে অন্যতম হচ্ছে এনআরবি গ্লোবাল ব্যাংক (বর্তমান নাম- এনআরবি ইসলামী ব্যাংক) ব্যাংক এর চেয়ারম্যান নিজাম চৌধুরী (যুক্তরাষ্ট্র আওয়ামী লীগের প্রথম সিনিয়র সহ-সম্পাদক), এনআরবি কমার্শিয়াল ব্যাংকের সাবেক চেয়ারম্যান ও যুক্তরাষ্ট্র আওয়ামী লীগের সাবেক সহ-সভাপতি ইঞ্জিনিয়ার ফরাসত আলী ও সাবেক প্রধানমন্ত্রীর ডেপুটি প্রেস সেক্রেটারী (চ্যানেল আই যুক্তরাষ্ট্র অফিসের নেপথ্য মালিক) আশরাফুল আলম খোকন। এই তিনজনের প্রবাস জীবন ছিল খুব সাধারণ। ফ্যাসিষ্ট সরকারের সময়কালে ক্ষমতার প্রভাব খাটিয়ে শত শত কোটি টাকার মালিক হয়ে গেছেন। উদাহরণ দিচ্ছি। নিজাম চৌধুরী ম্যানহাটানের ব্রডওয়েতে একটি পারফিউমের দোকানে বিক্রয় প্রতিনিধি হিসাবে দীর্ঘদিন কাজ করেছেন। পরে ওয়ালসফার্গো নামক একটি প্রতিষ্ঠানে মর্টগেজ ব্রোকারের কাজ করেছেন। ঐ প্রতিষ্ঠান থেকে চাকুরিচ্যূত হয়েছিলেন। তিনি যুক্তরাষ্ট্র আওয়ামী লীগের প্রচার সম্পাদক থাককালে আওয়ামী লীগের সভাপতি শেখ হাসিনার পুত্র সজীব ওয়াজেদ জয়কে কিছুদিন নিজের বাড়িতে রাখার সুযোগ পেয়েছিলেন। এটাই পরবর্তীতে তার ভাগ্যে ‘শাপে বর’ হয়। ২০০৮ সালে শেখ হাসিনা প্রধানমন্ত্রী হবার পর তিনি এনআরবি গ্লোবাল ব্যাংকের চেয়ারম্যান হয়ে যান। আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি তার। এরমধ্যে তিনি সখ্যতা গড়ে তুলেন এস.আলম. গ্রুপের কর্ণধার এস. আলমের সঙ্গে। ধূর্ত নিজাম চৌধুরী তার ছেলের সঙ্গে এস. আলমের ভাতিজীর বিয়ে দিতে পেরে হাতে যেন ক্ষমতার জাদুর চেরাগ পেয়ে যান। এস. আলম হয়ে যান তার প্রতিরক্ষার কবচ। এনআরবি গ্লোবাল ব্যাংক-এর তিন হাজার কোটি টাকা লোপাট হবার খবর ফাঁস হলে ব্যাংকটির এমডি পিকে হাওলাদার মামলার অন্যতম আসামী হলেও নিজাম চৌধুরী থেকে যায় ধরা-ছোঁয়ার বাইরে। তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ক্ষুব্ধ হলেও এস.আলমের কারণে নিজাম চৌধুরী বহাল তবিয়তে থাকেন। তবে বেশ কিছুদিন বাংলাদেশে বাস করেননি। পরে ব্যাংকটির নাম পরিবর্তন করে (এনআরবি ইসলামী ব্যাংক) এস. আলম নিজের দখলে নিয়ে নেন। নিজাম চৌধুরী এখনো ঐ ব্যাংকের চেয়ারম্যান। নিজাম চৌধুরী বাংলাদেশে বসবাসকালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি ক্যান্টিনে ম্যানেজার পদে চাকুরি করেছিলেন। ক্ষমতার প্রভাব খাটিয়ে তিনি ফ্যাসিষ্ট সরকারের আমলে ঐ বিশ্ববিদ্যালয়ে সিনেট সদস্য হয়েছিলেন। ফেনীর দাগন ভূইয়ার সন্তান তিনি।
সিলেটের সন্তান ইঞ্জিনিয়ার ফরাসত আলীর সঙ্গে গভীর সখ্যতা ছিল আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আশরাফুল ইসলামের। তার ম্যানহাটানে ‘গ্রেট ইন্ডিয়া’ নামে একটি মদের দোকান ছিল। সৈয়দ আশরাফুল নিউইয়র্ক এলে ফরাসত আলীর বাড়িতে উঠতেন। যুক্তরাষ্ট্র আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি হিসাবে শেখ হাসিনার সঙ্গেও পরিচয় ছিল তার। ২০০৮ সালে আওয়ামী লীগ রাষ্ট্র ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হলে ভাগ্য বদলে যায় ফরাসত আলীর। তিনি প্রবাসীদের কাছ থেকে অর্থ সংগ্রহ করে ‘এনআরবি কমার্শিয়াল ব্যাংক’ অনুমোদন লাভ করেন। এই ব্যাংকের বিপুল অর্থ তিনি হাতিয়ে নেন । ফ্যাসিষ্ট সরকারের আমলেই তিনি ব্যাংক থেকে বিতাড়িত হন। তার বিরুদ্ধেও মামলা দায়ের করা হয়েছিল। ফরাসত আলী বিপুল অর্থ পাচার করে এখন নিউইয়র্ক শহরে বসবাস করছেন। সাধারণ প্রবাসীদের উপস্থিতিতে তিনি যান না। তিনি ক্ষমতার প্রভাব খাটিয়ে তার শ্যালককে (স্বল্প অভিজ্ঞ আইনজীবী) উচ্চ আদালতের সহকারী এটর্নীর পদ বাগিয়ে দিয়েছিলেন।
আশরাফুল আলম খোকন বাংলাদেশে ‘চ্যানেল আই’ টিভির জুনিয়র রিপোর্টার ছিলেন। ডিভি লটারী পেয়ে তিনি স্ত্রীকে নিয়ে অভিবাসী হন যুক্তরাষ্ট্রে। নিউজার্সীর আটলান্টিক সিটিতে প্রবাস জীবন শুরু করেন এবং ক্যাসিনো’তে তাস ডিলার এর চাকুরি করতেন। ২০০৫ সালে চ্যানেল আই এর নিউইয়র্ক অফিসে চাকুরি পেয়ে নিউজার্সী ছেড়ে চলে আসেন। এই চ্যানেলের সংবাদ সংগ্রহ ও প্রচার করতে গিয়ে তার সঙ্গে পরিচয় হয় (তৎকালীন বিরোধী দলীয় নেত্রী) শেখ হাসিনার পুত্র সজীব ওয়াজেদ জয়ের সঙ্গে। সোহেল তাজ তার এলাকার সন্তান বলে তাকে সিঁড়ি হিসাবে ব্যবহার করেন খোকন। এই সিঁড়ির কারনে সজীব ওয়াজেদ জয়ের সঙ্গে বিশেষ সম্পর্ক গড়ে তুলতে সক্ষম হন। প্রধানমন্ত্রীর ডিপিএস পদে নিয়োগ পেয়ে যান জয়ের বদৌলতে। এই পদে যোগ দিয়ে তিনি ব্যাপকভাবে দুর্নীতি করতে থাকেন। পাপিয়ার মধুকুঞ্জে তার প্রভাবও ছিল বলে খবর বেরিয়েছিল। বিগত সরকারের আমলে খুব দ্রুত বিপুল পরিমাণ অর্থ হাতিয়ে ফেলেন খোকন। বিশেষ গোয়েন্দা সংস্থা তার বিরুদ্ধে দীর্ঘ একটি প্রতিবেদন দাখিল করেছিল প্রধানমন্ত্রীর অফিসে। সরকার প্রধানের কাছ থেকে অশনি সংকেত পেয়ে খোকন স্ত্রী ও দু’সন্তান নিয়ে ফিরে আসেন নিউইয়র্কে। এক সময় জ্যামাইকা এলাকায় এক বেডরুমের বাসায় ভাড়া থাকতেন। এখন অভিজাত এলাকায় বাড়ি ক্রয় করে বাস করছেন। আরো ৫টি বাড়ি কিনেছেন বলে জানা গেছে। কোন কাজ করেন না তিনি। তবে বিলাসী জীবন-যাপন করছেন। চ্যানেল আই এর নিউইয়র্ক অফিসে আড্ডা দিতে দেখা যায় তাকে।
বাংলাদেশে এক সময় সাংবাদিকতা করতেন মনজুরুল হক মন্জু। ১৯৯২ সালে নিউইয়র্কে বসবাস করতে থাকেন। যুবলীগ এর সাবেক একাধিক সভাপতির সঙ্গে তার ছিল দহরম-মহরম সম্পর্ক। শেখ সেলিম থেকে নানক অব্দি তার প্রভাব ছিল বলে যুক্তরাষ্ট্র আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে নেপথ্য শক্তির ভূমিকা পালন করতেন। ২০০১ সালের পর সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও তার পুত্র সজীব ওয়াজেদ জয়ের সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে তুলতে সক্ষম হন। এরপর ২০০৮ সালে আওয়ামী লীগ রাষ্ট্র ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হলে তিনি নিউইয়র্ক ছেড়ে স্থায়ীভাবে ঢাকায় বসবাস শুরু করেন। নিউইয়র্কে বাড়ি বেচাকেনার দালাল ছিলেন। বাংলাদেশে বসবাসের পর বিপুল অর্থ-বিত্তের মালিক হন। তিনি এনআরবি কর্মাশিয়াল ব্যাংকের পরিচালকও হয়েছিলেন। এরপর এটিএন নিউজ টিভির সঙ্গে ১০% মালিকানা নিয়ে পরিচালক পদে আসীন হন। ওখান থেকে বিরোধে জড়িয়ে বেরিয়ে আসেন এবং সাংবাদিক নেতা ইকবাল সোবহান চৌধুরীকে নিয়ে ডিবিএস টিভি চালু করেন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তাকে বিশেষ স্নেহ করতেন বলে খুব সহজে টিভি’র লাইসেন্স পেয়েছিলেন। জুলাই বিপ্লবে আওয়ামী সরকারের পতন হলে তিনি সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্রে চলে এসেছেন।
ড. নূরুন নবী পেশায় বিজ্ঞানী। দীর্ঘদিন যাবত যুক্তরাষ্ট্রে বাস করছেন। আওয়ামী রাজনীতির সঙ্গে জড়িত। বঙ্গবন্ধু পরিষদ নামে একটি সংগঠনের প্রতিষ্ঠাতা ও সংগঠনটির একটানা সভাপতি পদে রয়েছেন। তিনি এনআরবি গ্লোবাল ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ছিলেন। পারিবারিক জীবনে স্বচ্ছল হলেও ঐ ব্যাংকের বিপুল অর্থ লাপাত্তা হওয়ার সঙ্গে তার সম্পৃক্ততা রয়েছে বলে অনেকে মনে করেন। শত শত কোটি টাকার কু-ঋণে তার স্বাক্ষর রয়েছে বলে অভিযোগ রয়েছে। তিনি বিগত সরকারের সময়ে
‘একুশে পদক’ বাগিয়েছেন বলেও অভিযোগ রয়েছে। বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে তিনি এই পদক লাভ করেছেন, অথচ ভাল বাংলা লিখতে পারেন না। তিনি ফেসবুকে প্রায়ই ইংরেজীতে বক্তব্য পোষ্ট করেন। এখন তিনি অন্তবর্তী সরকার বিরোধী প্রচারণা চালিয়ে যাচ্ছেন।
যুক্তরাষ্ট্র আওয়ামী লীগের আরো অনেক নেতার ভাগ্যই বদলে গেছে গত ১৫ বছরে। তারা যুক্তরাষ্ট্রে সম্পত্তি গড়েছেন অনায়াসে। কয়েকজন বিদ্যুৎ উপকেন্দ্র খুলে সরকারের কাছ থেকে চড়া দামে বিদ্যুত বিক্রি করে দেদারছে অর্থ কামিয়ে নিয়েছেন। এদের অধিকাংশ এখন জনসম্মুখে খুব একটা আসছেন না। তবে মার্কিন মূলধারার রাজনীতিবিদদের কাছে পলাতক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পক্ষে সহানুভূতি সৃষ্টি হওয়ার মত পত্র পাঠাচ্ছেন। বিভিন্ন সময় বিভিন্ন স্থানে অন্তবর্তীকালীন সরকার বিরোধী সমাবেশ আয়োজনে অর্থ দিচ্ছেন তারা।