আয়নায় তাকিয়ে মাথায় একটি ব্রাশ বোলাতে বোলাতে কাঁদতে থাকে শামা তুবাইলি। মাথায় হাত রেখে শামা সিএনএনকে বলল, ব্রাশ দিয়ে আঁচড়ানোর জন্য আমার এক চিলতে চুলও অবশিষ্ট নেই। এ জন্য আমার মন ভীষণ খারাপ। আমি আয়না ধরে থাকি। কারণ, আমি আমার চুল আঁচড়াতে চাই। আমি সত্যিই আবার আমার চুল আঁচড়াতে চাই।
মাথায় চিরুনি বোলালে আট বছরের এ শিশুর ২০২৩ সালের ৭ অক্টোবরের আগের স্মৃতি মনে পড়ে যায়। সে পরিবারের সঙ্গে উত্তর গাজার জাবালিয়ায় থাকত। তখন তার মাথায় লম্বা চুল ছিল। বাড়ির বাইরে বন্ধুদের সঙ্গে খেলতে যেত। কিন্তু ৭ অক্টোবরের পর থেকে শামা ও তার পরিবার প্রায় ১৯ লাখ মানুষের কাতারে শামিল হয়েছেন, যারা তাদের বাড়ি এক বা একাধিকবার ছাড়তে বাধ্য হয়েছেন।
ইসরায়েলি সেনাবাহিনীর নির্দেশে শামার পরিবার প্রথমবারের মতো জাবালিয়া ছেড়ে দক্ষিণে রাফায় চলে যায়। সহিংসতা বাড়তে থাকলে তারা সেখান থেকে আবার তল্পিতল্পা গুঁটিয়ে মধ্য গাজার খান ইউনিসে একটি শরণার্থীশিবিরে আশ্রয় নেয়।
২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর ফিলিস্তিনের স্বাধীনতাকামী সংগঠন হামাস ইসরায়েলে নজিরবিহীন হামলা চালায়। এতে এক হাজার ২০০ জন নিহত হন বলে দাবি ইসরায়েলি কর্তৃপক্ষের। এ ছাড়া জিম্মি করা হয় ২৫০ জনের বেশি মানুষকে। প্রতিশোধ নিতে সেদিনই গাজায় তাণ্ডব শুরু করে ইসরায়েলি সামরিক বাহিনী। তাদের বেপরোয়া বোমা হামলা ও স্থল অভিযানে সেখানে ৪৮ হাজারের বেশি ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন বলে জানিয়েছে গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়। তাদের মধ্যে বেশির ভাগই নারী ও শিশু। এ যুদ্ধ বন্ধে সম্প্রতি একটি যুদ্ধবিরতি চুক্তির অধীন প্রায় দুই মাসের জন্য ইসরায়েলি আগ্রাসন বন্ধ ছিল।
জাতিসংঘের শিশুবিষয়ক সংস্থা ইউনিসেফ গত বছরের জুনে এক প্রতিবেদনে জানিয়েছিল, গাজার ১২ লাখ শিশুর প্রায় সবারই মানসিক সহায়তা প্রয়োজন; বিশেষ করে যারা বারবার যুদ্ধের বিভীষিকার সম্মুখীন হয়েছে।
জাতিসংঘের মানবাধিকার প্রধান টম ফ্লেচার গত জানুয়ারিতে ইসরায়েল ও হামাসের মধ্যে যুদ্ধবিরতি ঘোষণার এক সপ্তাহ পর নিরাপত্তা পরিষদে বলেন, ‘একটি প্রজন্ম মানসিক আঘাতে জর্জরিত হয়ে পড়েছে। শিশুদের হত্যা করা হয়েছে। তাদের অনেকে অনাহারে কিংবা ঠান্ডায় জমে মারা গেছে। কিছু শিশু প্রথম শ্বাস নেওয়ার আগেই মারা গেছে— ভূমিষ্ঠ হওয়াকালে।’
কেন আমার চুল গজাচ্ছে না: গত বছর চিকিৎসকেরা পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে দেখেছেন, শামা তুবাইলির চুল পড়ার কারণ, নার্ভাস শক (বিভীষিকাময় কোনো ঘটনায় মানসিক আঘাত পাওয়া); বিশেষ করে গত বছরের আগস্টে রাফায় তার প্রতিবেশীর বাড়িতে ইসরায়েলি বিমান হামলার পর। ৭ অক্টোবরের পর থেকে তার দৈনন্দিন জীবন ভীষণভাবে ওলট-পালট হয়ে গেছে। এটিও সম্ভবত তার ‘অ্যালোপেসিয়া’তে ভূমিকা রেখেছে। অ্যালোপেসিয়া এমন একটি অবস্থা, যার কারণে মানুষের চুল পড়ে বা টাক হয়ে যায়।
গত বছরের শেষের দিকে ওয়ার চাইল্ড অ্যালায়েন্স ও গাজাভিত্তিক কমিউনিটি ট্রেনিং সেন্টার ফর ক্রাইসিস ম্যানেজমেন্টের একটি প্রতিবেদনে গাজায় ইসরায়েলি আক্রমণের ফলে শিশুদের ওপর যে মারাত্মক মানসিক আঘাত নেমে এসেছে, সে বিষয়ে তুলে ধরা হয়েছে। সংকটাপন্ন শিশুদের পরিচর্যাকারী পাঁচ শতাধিক লোকের ওপর সমীক্ষা চালিয়ে এ–সংক্রান্ত প্রতিবেদন তৈরি করা হয়। প্রতিবেদনে দেখা গেছে, ওই পরিস্থিতিতে ৯৬ শতাংশ শিশু মনে করেছে, তাদের মৃত্যু অত্যাসন্ন। প্রায় অর্ধেক (৪৯ শতাংশ) শিশু আক্রমণের কারণে ‘মরে যাওয়ার ইচ্ছা’ প্রকাশ করেছে।
চুল পড়া নিয়ে অন্য শিশুদের কটাক্ষের শিকার হয়ে শামার মানসিক যন্ত্রণা আরো হয়ে ওঠে। ফলে সে ঘর থেকে বের হয় না বললেই চলে। বের হলেও মাথায় গোলাপি রঙের ব্যান্ডানা (রুমালবিশেষ) পড়ে থাকে।
২০২৪ সালের সেপ্টেম্বরে সিএনএন যখন শামার পরিবারের সঙ্গে দেখা করে, তখন সে তার মা ওম-মোহাম্মদের কাছে অনুনয় করে বলে, ‘মা, আমি ক্লান্ত, মরে যেতে চাই। আমার চুল কেন গজাচ্ছে না?’ এরপর জিজ্ঞাসা করে, সে কি আজীবন টাক থাকবে? শামা আরো বলে, ‘আমি মরে যেতে চাই এবং চাই স্বর্গে গিয়ে আমার চুল গজাক।’
ভঙ্গুর যুদ্ধবিরতি চুক্তি কার্যকর হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে লাখো বাস্তুচ্যুত ফিলিস্তিনি উত্তর গাজায় তাদের বাড়িঘরে ফিরতে শুরু করেন (যদিও বাড়িঘরের অধিকাংশই ধ্বংসস্তূপে পরিণত)। ইসরায়েলের ছোড়া বোমায় শামা তুবাইলিদের বাড়িও মাটিতে মিশে গেছে। এ কারণে সে আর তার পরিবার খান ইউনিসেই থেকে যায়। বাড়ি ফেরার জন্য তাঁদের কাছে পরিবহন খরচও পর্যন্ত ছিল না।
এ বছরের ফেব্রুয়ারিতে সিএনএন এই শিশুর পরিবারের সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিল। তখন সে বলেছিল, ‘আমাদের বাড়ি বোমা হামলায় বিধ্বস্ত হয়েছে। বাড়িতে আমার অনেক ছবি ছিল, সার্টিফিকেট ছিল, ছিল অনেক স্মৃতি। আমার জামাকাপড় ও অনেক জিনিসপত্র ছিল। কিন্তু বাড়িটি ধ্বংস হয়ে গেছে। এর পর থেকে আমি বাড়িটি কখনো দেখিনি।’ সে আরো বলেছে, ‘পরিবহন খরচ অনেক বেশি। এ ছাড়া আমরা গেলেও কোথায় থাকব, জানি না। সেখানে কোনো পানি নেই।’
স্বাস্থ্যকর্মীরাও মানসিক আঘাতের শিকার: গাজায় মানসিক স্বাস্থ্যসেবা দেওয়ার কাজটি সব সময়ই চ্যালেঞ্জিং। কিন্তু গাজা কমিউনিটি মেন্টাল হেলথ প্রোগ্রামের (জিসিএমএইচপি) পরিচালক ডা. ইয়াসের আবু জামেই জানান, ১৫ মাস ধরে চলা ইসরায়েলি আক্রমণে তার কর্মীরাও মানসিক আঘাতের শিকার হয়েছেন। এ অবস্থায় অন্যদের চিকিৎসা করা তাদের জন্য কঠিন হয়ে পড়েছে।
আবু জামেই জানুয়ারিতে যুদ্ধবিরতি হওয়ার আগে সিএনএনকে এক সাক্ষাৎকারে বলেন, ‘আমার বেশির ভাগ কর্মী বাস্তুচ্যুত এলাকায় থেকে কাজ করছেন। ১০ জনেরও কম এখনো নিজেদের বাড়িতে আছেন। তারা কাজ চালিয়ে যাচ্ছেন। আশ্রয়কেন্দ্রে কাজ করার সময় পরিবারগুলোর মনে আশা জাগানোর ও তাদের সহায়তা করার চেষ্টা করছেন।’
জিসিএমএইচপি অঙ্কন থেরাপি নামের একটি কৌশল ব্যবহার করে জানিয়ে আবু জামেই বলেন, অ-মৌখিক যোগাযোগের মাধ্যমে এ থেরাপিতে শিশুদের অনুভূতি প্রকাশ করতে দেওয়া হয়। তিনি একটি ঘটনা স্মরণ করে বলেন, একটি শিশুকে আঁকার জন্য একটি জায়গা দেওয়া হয়, যার মাধ্যমে সে তার মানসিক আঘাত সম্পর্কে একজন মনোবিজ্ঞানীর সঙ্গে কথা বলতে সক্ষম হয়।
আবু জামেই বলেন, ‘(শিশুটি বলেছে) আমার বন্ধুরা এখন স্বর্গে। তবে তাদের মধ্যে একজনের মরদেহ পাওয়া গিয়েছিল মস্তকবিহীন। তার মাথা যদি না থাকে, সে কীভাবে স্বর্গে যাবে? বলতে বলতে (শিশুটি) কেঁদে ফেলে।’
আমারবাঙলা/এমআরইউ