ভোটাধিকার প্রয়োগের আক্ষেপ নিয়েই আজ সারাদেশে জাতীয় ভোটার দিবস উদযাপিত হচ্ছে। ‘তোমার আমার বাংলাদেশে, ভোট দিবো মিলেমিশে’— প্রতিপাদ্যে ২ মার্চ (রবিবার) দেশে সপ্তমবারের মতো জাতীয় ভোটার দিবস উদযাপন করা হচ্ছে।
২০২৪ সালে হালনাগাদ করা চূড়ান্ত ভোটার তালিকা আজ রবিবার প্রকাশ করবে নির্বাচন কমিশন (ইসি)। ভোটাধিকার সম্পর্কে জনসচেতনতা বাড়ানোর লক্ষ্যে ২০১৮ সালের ২ মার্চ থেকে দিনটি পালন করে আসছে সংস্থাটি।
২০১৮ সালের এপ্রিল মাসে অনুষ্ঠিত মন্ত্রিসভার বৈঠকে ‘গণতন্ত্র, নির্বাচন ও ভোটাধিকার বিষয়ে সচেতনতা তৈরির লক্ষ্যে’ প্রতি বছরের ১ মার্চকে জাতীয় ভোটার দিবস হিসেবে উদযাপন করার সিদ্ধান্ত নেয় বাংলাদেশ সরকার। তবে পরের বছর ২০১৯ সাল থেকে এই ভোটার দিবস উদযাপনের তারিখ পরিবর্তন করে ২ মার্চ করা হয়।
এ দিবস উদযাপন উপলক্ষে ইতোমধ্যেই নির্বাচন কমিশন সচিবালয় হতে যাবতীয় প্রস্তুতি নেওয়া হয়েছে।
নির্বাচন কমিশন সূত্র জানায়, জাতীয় ভোটার দিবস উদযাপন উপলক্ষে কেন্দ্রীয়ভাবে ঢাকাতে নির্বাচন কমিশন সচিবালয়ে এবং মাঠপর্যায়ে থানা বা উপজেলা, জেলা ও আঞ্চলিক নির্বাচন অফিসগুলোতে বিভিন্ন কর্মসূচি গ্রহণ করা হয়েছে।
ঢাকায় সকাল ৯টায় প্রধান নির্বাচন কমিশনার কর্তৃক নির্বাচন ভবনের সামনে থেকে জাতীয় ভোটার দিবস ২০২৫-এর শুভ উদ্বোধন করা হবে। এ সময় নির্বাচন কমিশনাররা উপস্থিত থাকবেন। এরপর নির্বাচন ভবনের সামনে থেকে বর্ণাঢ্য র্যালি বের করা হবে।
সকাল ১১টায় নির্বাচন ভবনের অডিটোরিয়ামে ভোটার দিবস নিয়ে আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত হবে। অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত থাকবেন প্রধান নির্বাচন কমিশনার।
এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়, ইসির আলোচনা সভায় বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের সমন্বয়কদের মধ্য থেকে ১০ জন, ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের প্রতিনিধি, ইউএনডিপির প্রতিনিধি, সুশীল সমাজের প্রতিনিধি হিসেবে অবজারভার গ্রুপ থেকে কয়েকজন ব্যক্তিকে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে। এ ছাড়া র্যালিতে কোনো একজন সেলিব্রেটি থাকবেন বলেও জানানো হয়।
জাতীয় ভোটার দিবস উদযাপন উপলক্ষে জাতীয় দৈনিকগুলোতে বিশেষ প্রকাশনা স্থান পেয়েছে। বাংলাদেশ টেলিভিশন ও বাংলাদেশ বেতারে ভোটার দিবসের গুরুত্ব ও তাৎপর্যের বিষয়ে বিশেষ অনুষ্ঠান প্রচারিত হচ্ছে।
মাঠপর্যায়ে জেলা, উপজেলা ও আঞ্চলিক নির্বাচন অফিসগুলোতেও র্যালি ও আলোচনা সভার আয়োজন করা হয়েছে বলে জানান নির্বাচন কমিশন সচিবালয় সহকারী পরিচালক জনসংযোগ মো. আশাদুল হক।
নির্বাচন-সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, অতীতের অভিজ্ঞতায় দেখা গেছে, দলীয় সরকারের অধীন কোনো নির্বাচন সুষ্ঠু হয়নি। নির্বাচন কমিশনও স্বাধীনভাবে কাজ করেনি। ভোটের সময় গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বে থাকে পুলিশ ও প্রশাসন। দলীয় সরকারের অধীন তারাও সরকারি দলের পক্ষে কাজ করে। অন্যদিকে নির্দলীয় সরকারের অধীন নির্বাচন মোটামুটি সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য হয়েছে। এবার অন্তর্বর্তী সরকারের অধীন নির্বাচন হবে। ফলে নির্বাচন সুষ্ঠু হওয়ার সুযোগ বেশি।
তবে এখন পর্যন্ত আগামী নির্বাচনে মূল চিন্তার কারণ হবে পুলিশ ও প্রশাসনের সক্ষমতা। নির্বাচনে আইনশৃঙ্খলা রক্ষার দায়িত্ব পালন করে থাকে মূলত পুলিশ। আর সংসদ নির্বাচনে রিটার্নিং ও সহকারী রিটার্নিং কর্মকর্তার দায়িত্বে থাকেন প্রশাসনের কর্মকর্তারা। আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর থেকে এখন পর্যন্ত পুলিশ বাহিনী পুরোপুরি সক্রিয় হতে পারেনি। দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আসেনি। প্রশাসনেও এখনো পুরো শৃঙ্খলা ফেরেনি।
অন্যদিকে শেখ হাসিনার সরকারের পতনের পর এখন পর্যন্ত কোনো নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়নি। নির্বাচন কমিশনও পুরোপুরি নতুন। তাদের কোনো নির্বাচন পরিচালনা করার অভিজ্ঞতা নেই। ফলে নতুন কমিশনের সক্ষমতা এবং পুলিশ ও প্রশাসন কতটা দায়িত্ব পালন করতে পারবে, তার পরীক্ষা এখন পর্যন্ত হয়নি। এ ছাড়া নির্বাচনব্যবস্থা সংস্কার কমিশন যেসব সুপারিশ সরকারকে দিয়েছে, সেগুলো কতটা কার্যকর হয়, সেটির ওপরও অনেক কিছু নির্ভর করবে।
নির্বাচনবিশেষজ্ঞ আবদুল আলীম বলেন, ৫ আগস্টের পর এখনো কোনো নির্বাচন হয়নি। তবে অতীত অভিজ্ঞতা থেকে বলা যায়, তত্ত্বাবধায়ক বা অন্তর্বর্তী সরকারের অধীন ভোটাধিকার প্রয়োগে ঝামেলা হয় না। তবে গত দেড় দশকে অনেক মানুষ ভোটে আগ্রহ হারিয়েছেন। অনেকে ভোটার হননি। সবাইকে ভোটার তালিকাভুক্ত করা একটি চ্যালেঞ্জ। তিনি আশা করেন, আগামী নির্বাচনের আগে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক হবে। ভয় কাজ করলে মানুষ ভোটকেন্দ্রে যাবেন না। এ জন্য একটি ‘সমন্বিত নির্বাচনী নিরাপত্তাব্যবস্থা’ পরিকল্পনা করা প্রয়োজন।
দিনক্ষণ ঠিক না হলেও আগামী ডিসেম্বরে জাতীয় নির্বাচন আয়োজনের লক্ষ্যে প্রস্তুতি নিচ্ছে এ এম এম নাসির উদ্দীনের নেতৃত্বাধীন নির্বাচন কমিশন। পরিবর্তিত রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে তারা সুষ্ঠু নির্বাচন আয়োজনে বড় কোনো চ্যালেঞ্জ দেখছে না। নির্বাচন কমিশনার আনোয়ারুল ইসলাম সরকার বলেন, এবারের জাতীয় ভোটার দিবসের প্রতিপাদ্যের মর্মার্থ হচ্ছে, ইসি মনে করে না স্বচ্ছ ও সুষ্ঠু ভোটের জন্য কোনো চ্যালেঞ্জ আছে। নির্বাচন কমিশন খুব শক্ত এবং নিরপেক্ষভাবে এগিয়ে যাচ্ছে। একটি সর্বোৎকৃষ্ট নির্বাচন উপহার দেওয়ার জন্য কমিশন প্রস্তুতি নিচ্ছে।
তবে প্রয়োজনীয় সংস্কার ছাড়া অবাধ, সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন অনুষ্ঠান এবং একটি কার্যকর নির্বাচনব্যবস্থা গড়ে তোলা সম্ভব হবে না বলে মনে করেন নির্বাচনব্যবস্থা সংস্কার কমিশনের প্রধান, সুশাসনের জন্য নাগরিকের (সুজন) সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদার। তিনি বলেন, স্বৈরাচার আকাশ থেকে পড়েনি। বিদ্যমান বিধিবিধান, আইন–বিধি, পদ্ধতি-প্রতিষ্ঠান এ ক্ষেত্রে সহায়ক ছিল। তিনি বলেন, সুষ্ঠু নির্বাচনের পথে এখনো অনেক চ্যালেঞ্জ আছে। নির্বাচনী অঙ্গন ও রাজনৈতিক অঙ্গনকে পরিচ্ছন্ন করতে হবে। টাকার খেলা এবং পুলিশ প্রশাসনের পক্ষপাতমূলক আচরণ বন্ধ করা, নির্বাচন কমিশনকে কার্যকর ও দায়বদ্ধতার অধীন করা, প্রার্থীদের হলফনামার তথ্য যাচাইয়ের মতো বেশ কিছু কাজ করতে হবে। এসব করতে বেশ কিছু আইনি, প্রাতিষ্ঠানিক ও কাঠামোগত সংস্কার প্রয়োজন।
আমারবাঙলা/এমআরইউ