নিজস্ব প্রতিবেদক: রাজধানীতে বৃষ্টি হলেই জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হয়। আর জলাবদ্ধতার এই সমস্যা প্রতিবছরই অব্যাহত থাকছে।
বুধবার সকালে রাজধানীতে ভারী বৃষ্টিপাত হয়েছে। বৃষ্টিতে ঢাকার দুই মহানগরীর অনেক এলাকায় জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হয়। কিছু এলাকায় জলাবদ্ধতার পরিমাণ ছিল হাঁটু কিংবা কোমরসমান।
মিরপুরের কাজীপাড়া এলাকার সড়কে প্রায় কোমরসমান পানি জমে ছিল। এছাড়াও ঢাকা উত্তর সিটির মিরপুরের পাইকপাড়া, কাজীপাড়া, শেওড়াপাড়া, মিরপুর-১০ নম্বর, ফার্মগেটের পশ্চিম রাজাবাজার, বাড্ডা, মেরুল বাড্ডা, বিমানবন্দর সড়ক, তুরাগ, উত্তরখান ও দক্ষিণখানের বিভিন্ন এলাকায় জলাবদ্ধতা হয়েছে।
এদিকে ঢাকা দক্ষিণ সিটির গ্রিন রোড, কাঁঠালবাগান, নিউমার্কেট, মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক শিক্ষা বোর্ড-সংলগ্ন অরফানেজ রোড, হরনাথ ঘোষ রোড, হোসেনি দালান রোড, চানখাঁরপুল, কাজী আলাউদ্দিন রোড, বংশাল, মতিঝিল বলাকা মোড়, দিলকুশা, আরামবাগ, ফকিরাপুল, নয়াপল্টন, নাইটিঙ্গেল মোড়, শান্তিনগর, কাকরাইল, রাজারবাগ ও জুরাইন এলাকায় জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হয়।
এছাড়া, রাজধানীতে চলতি বছর ১১ মে সকালে টানা এক ঘণ্টায় ৮৬ মিলিমিটার বৃষ্টিপাতে নগরের বিভিন্ন এলাকায় জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হয়। অর্ধশতাধিক সড়ক-গলিতে বৃষ্টির পানি জমে ছিলো। এর মধ্যে ভাটারার সোলমাইদ ছাপরা মসজিদ এলাকায় হাঁটুপানি জমে ছিলো। নতুনবাজারে প্রগতি সরণিতেও পানি জমেছিল। দক্ষিণখান, উত্তরখান, মিরপুর-১০ থেকে ১৪ নম্বর, আগারগাঁও থেকে জাহাঙ্গির গেট যেতে নতুন রাস্তায়, খামারবাড়ি থেকে ফার্মগেট, ফার্মগেট-তেজগাঁও ট্রাকস্ট্যান্ড সংলগ্ন এলাকা, কাজীপাড়া, শেওড়াপাড়া, কালশী রোড, মেরুল বাড্ডা, ডিআইটি প্রজেক্ট এলাকা, মোহাম্মদপুর, ইসিবি, নূরের চালা, বাড্ডাসহ বিভিন্ন স্থানে পাঁচ থেকে ছয় ঘণ্টা পর্যন্ত পানি জমে ছিল। পল্লবীর কালশী রোডে কোথাও বুকসমান পানি, আবার কোথাও হাঁটুপানি জমেছিল।
এর মধ্যে কালশী রোডের ২২ তলা গার্মেন্টসের সামনে বৃষ্টির পানিতে জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হয়। এছাড়াও সাম্প্রতি ঘূর্ণিঝড় রেমালের প্রভাবে ভারী বৃষ্টিতে ঢাকা দক্ষিণ সিটিতে বৃষ্টিতে নিউ মার্কেট, পুরান ঢাকার বংশাল, নাজিমুদ্দিন রোড, ধানমণ্ডি ২৭, সায়েদাবাদ, শনির আখড়ার বিভিন্ন সড়কে জলাবদ্ধতা হয়েছে। এর মধ্যে বংশাল ও নিউ মার্কেট এলাকায় সবচেয়ে বেশি পানি জমেছিল।
এতে অনেকটা বন্ধ হয় যান চলাচল। স্থানীয় ভুক্তভোগীদের থেকে জানা যায়, ভারী বৃষ্টি হলে অনেকের ঘরে পানি প্রবেশ করেছে। রাতে ঘুমাতে সমস্যায় পড়েন তারা। বছরের পর বছর ধরে নগরজুড়ে চলা এত ভোগান্তি থেকে মুক্তি চান সাধারণ মানুষ।
মিরপুরের স্থানীয় বাসিন্দা মুকবুল ইসলাম বলেন, বিগত বছরেও কালশীতে জলাবদ্ধতার কারণে ভোগান্তিতে পড়তে হয়েছে আমাদের। এবার কয়েকদিন আগের বৃষ্টিতেও পানি জমেছিল। সড়কের পানি নামতে দশ ঘণ্টার বেশি সময় লেগেছে। অথচ প্রতি বছর বর্ষার আগে জলাবদ্ধতা নিরসনের কথা বলেন ডিএনসিসি মেয়র। কিন্তু এ সমস্যা স্থায়ীভাবে সমাধানের কোনো উদ্যোগ নেই।
জলাবদ্ধতার বিষয়ে জানতে চাইলে ঢাকা দক্ষিণ সিটির জনসংযোগ কর্মকর্তা আবু নাছের বলেন, বর্ডার গার্ড বাংলাদেশের (বিজিবি) সদর দপ্তরের মধ্য দিয়ে যাওয়া একটি নালা বন্ধ ও আরেকটি নালা দিয়ে ঢাকা ওয়াসা পানির সংযোগ নেওয়ায় নিউমার্কেট এলাকায় জলাবদ্ধতা হচ্ছে। এ ছাড়া দ্রুতগতির উড়ালসড়ক (এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের) নির্মাণকাজ চলমান থাকায় গ্রিন রোড, মতিঝিল, কমলাপুর, ফকিরাপুল, পল্টন ও মগবাজার এলাকায় জলাবদ্ধতা হচ্ছে বলে তিনি জানান।
সূত্র বলছে, ২০০১ সাল থেকে ঢাকা ওয়াসা জলাবদ্ধতা নিরসনের জন্য ২০০ কোটিরও বেশি টাকার প্রকল্প বাস্তবায়ন শুরু করে। প্রকল্পের আওতায় নগরীর ২৬৫ কিলোমিটার এলাকায় ভূগর্ভস্থল পাইপলাইন স্থাপন, বক্সকালভার্ট, খালের পানি নিষ্কাশনসহ বিভিন্নভাবে জলাবদ্ধতা নিরসনের জন্য কাজ শুরু হয়। পাঁচ বছর মেয়াদি এই প্রকল্প তিন মেয়াদে বেড়ে ২০১০ সালে শেষ হয়।
এতে এর নির্মাণ ব্যয় ১৪৬ কোটি ৫৯ লাখ টাকা থেকে বেড়ে ২০৩ কোটি ২৬ লাখ টাকায় দাঁড়ায়। জলাবদ্ধতা নিরসনে এত বড় মেগাপ্রজেক্ট শেষ করেও পরিত্রাণ পাওয়া যায়নি জলাবদ্ধতা থেকে। পরে নগরীর জলাবদ্ধতা নিরসনে আরো ১৮০ কোটি টাকা সরকার থেকে বরাদ্দ দেওয়া হয় ২০১০ সালে। তবে প্রতি বছর এমন বিপুল পরিমাণ অর্থ বরাদ্দ দেওয়া হলেও কার্যকর কোনো সুবিধা পায়নি নগরবাসী।
ঢাকার ৪০টি খাল দখলমুক্ত ও সংস্কার করে পূর্বাবস্থায় ফিরিয়ে আনার জন্য ২০২০ সালের ডিসেম্বরে এ খালগুলো রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব ঢাকা ওয়াসার কাছ থেকে সরিয়ে নিয়ে ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনকে হস্তান্তর করা হয়। ড্রেনেজের উন্নয়নে অর্থ বরাদ্দও কম নয়। এত কিছুর পরও জলাবদ্ধতার দুর্ভোগ থেকে মুক্তি মেলেনি নগরবাসীর, সেই সঙ্গে ঘটছে প্রাণহানির ঘটনা। ১০ বছরে জলাবদ্ধতা নিরসনে ঢাকা ওয়াসা ব্যয় করেছে প্রায় ২ হাজার ২৫ কোটি টাকা।
ঢাকা ওয়াসা ছাড়াও ড্রেনেজ খাতের উন্নয়নে ঢাকার দুই সিটি করপোরেশন ২০২০ সাল পর্যন্ত প্রায় ৫৭৩ কোটি টাকা ব্যয় করেছে। পরের আড়াই বছরে অর্থাৎ ২০২২-২০২৩ অর্থবছর পর্যন্ত ব্যয় হয়েছে আরও ৪০০ কোটি টাকা। এভাবে নানা সময় ঢাকা ওয়াসা এবং সিটি কর্পোরেশনসহ বিভিন্ন সংস্থা জলাবদ্ধতা নিরসনে প্রায় ৩ হাজার কোটি টাকা ব্যয় করেছে কিন্তু নগরবাসী কোনো সুফল পাননি।
ডিএসসিসির প্রকৌশল বিভাগ সূত্র জানিয়েছে, জলাবদ্ধতা নিরসনে তারা বেশ কিছু পদক্ষেপ নিয়েছে। এর মধ্যে ২০২০ সালে ঢাকা ওয়াসার কাছ থেকে বুঝে নেওয়া ১১টি খাল থেকে সব বর্জ্য অপসারণ করা হয়েছে। খালগুলোতে পানিপ্রবাহ ঠিক রাখতে নিয়মিত পরিষ্কার রাখা হচ্ছে। এ ছাড়া বক্স কালভার্ট ও নর্দমা পরিষ্কার রাখা হচ্ছে।
জলাবদ্ধতা সমস্যা নিরসনে দুই মেয়রের আশ্বাসের প্রসঙ্গ উল্লেখ করে বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্সের সাবেক সাধারণ সম্পাদক মো. আবু নাইম সোহাগ বলেন, 'মেয়ররা যখন বারবার করে বলছিলেন যে জলাবদ্ধতা থাকবে না, তখন আমরাও বারবার বলেছি যে, তারা হয়তো কিছু কাজ করেছেন, তাতে তাদের সন্তুষ্টি থাকতে পারে। কিন্তু বৃষ্টি হলে ঢাকায় জলাবদ্ধতা থাকবে না-এই বাস্তবতা থেকে ঢাকা অনেক দূরে। জলাবদ্ধতা নিরসনে যে সাফল্যের গল্প মেয়ররা বলে আসছেন, তা অনেকটা রাজনৈতিক বক্তব্যের মতো' বলেও মন্তব্য করেন তিনি।
২০১৭ সালে একটি প্রতিবেদনে জানা যায়, সরকারিভাবে চিহ্নিত ঢাকা শহরের মোট ৫৮টি খালের মধ্যে ৩৭টি খালের অংশবিশেষ ১০টি সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠান, রাজনৈতিক দল ও ২৪৮ জন ব্যক্তি পর্যায়ের মানুষ দখল করে নিয়েছে।
ড্রেনেজ ডিজাইন কোড অনুযায়ী ঢাকায় প্রতি ঘণ্টায় ৩০ মিলিমিটার (৬ ঘণ্টায় ১৮০ মিলিমিটার) পর্যন্ত বৃষ্টি হলেও সেই পানি ড্রেন ও খালের মাধ্যমে নিষ্কাশনের সক্ষমতা থাকতে হবে। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে, ডিজাইন রেইনের প্রায় ৫০-৬০ শতাংশ বৃষ্টি হলেও ঢাকা শহরের বিভিন্ন এলাকায় ও রাস্তায় দীর্ঘস্থায়ী জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হচ্ছে। জলাবদ্ধতার কারণ হিসেবে বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্স (বিআইপি)-এর এক সমীক্ষায় দেখা গেছে, গত নয় বছরে ঢাকার মহানগর ও এর আশপাশে কমপক্ষে ৩ হাজার ৪৮৩ একর জলাশয় এবং নিম্নভূমি ভরাট হয়েছে এবং ২০১০ সালে প্রণীত বিশদ অঞ্চল পরিকল্পনা (ড্যাপ)-এর নিয়মনীতি উপেক্ষা করে ঢাকার ৩৬% জলাশয় ও নিম্নাঞ্চল ভরাট করা হয়েছে। তারা আরও বলছে, রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (রাজউক) এর আওতাধীন নগরীর বিভিন্ন অংশে নয় বছর আগে ১ লাখ ৯৩৭ একর জলাশয় এবং নিম্নভূমি ছিল, কিন্তু ইতোমধ্যে এর মধ্যে ২২% অর্থাৎ ২২ হাজার ১৫৬ একর ভরাট করা হয়েছে, যা প্রতিবছর জলাবদ্ধতার একটি কারণ।
এছাড়াও ঢাকার জলাবদ্ধতার অন্যতম হিসেবে দেখা যায়, ময়লা-আবর্জনা জমে ড্রেন ও বক্স কালভার্টগুলো সক্ষমতা অনুযায়ী পানি প্রবাহ করতে না পারা, খালগুলো দখল হয়ে সরু নালায় পরিণত হওয়া ও খালগুলো ময়লা-আবর্জনার স্তূপে পরিণত হওয়ায় বৃষ্টির পানি নিষ্কাশনে খুবই ধীরগতি, নগরের ময়লা-আবর্জনা সংগ্রহে দুর্বল ব্যবস্থাপনা ও জনগণের অসচেতনতা।
বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্সের (বিআইপি) সভাপতি আদিল মুহাম্মদ খান বলেন, সরকারি বিভিন্ন সংস্থার মাধ্যমে জলাশয়-জলাধার ভরাট হচ্ছে। ফলে ঢাকায় ৬০-৭০ মিলিমিটার বৃষ্টি হলেই জলাবদ্ধতা হয়, মানুষের ভোগান্তি হয়। জলাবদ্ধতা নিরসনে ২০২৩-২০২৪ অর্থবছরে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন লেক মেরামত ও রক্ষণাবেক্ষণ খাতে বরাদ্দ রেখেছে ৫ কোটি টাকা, ড্রেন ক্লিনিং খাতে রাখা হয়েছে ৫ কোটি টাকা, খাল পরিষ্কারেও সংস্থাটি ব্যয় করবে ৫ কোটি টাকা।
এ ছাড়া পাম্প হাউসের যন্ত্রপাতি আধুনিকীকরণ, উন্নয়ন ও ক্রয়বাবদ বরাদ্দ রাখা হয়েছে ২৫ কোটি টাকা। অন্যদিকে, ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন ২০২৩-২০২৪ অর্থবছরে জলাবদ্ধতা দূরীকরণের জন্য বাজেটে বরাদ্দ রেখেছে ৯০ কোটি টাকা। এ ছাড়া ‘খাল পুনরুদ্ধার, সংস্কার ও নান্দনিক পরিবেশ সৃষ্টি’ নামের প্রকল্পে ব্যয় ধরেছে ২০৭ কোটি ৭১ লাখ টাকা।
গত বছর দুই সিটি করপোরেসন জলাবদ্ধতা নিরসনে দুটি প্রস্তাব পাঠায় মন্ত্রণালয়ে। ১৪ জুলাই ডিএসসিসি জলাবদ্ধতা নিরসনে ১টি প্রস্তাব পাঠায়। ডিএসসিসি ‘জলাবদ্ধতা নিরসন শাখা’ নাম দেওয়া হয়েছে এতে ডিএসসিসি কেন্দ্রীয় ও আঞ্চলিক কার্যালয়ে মোট ১১৪টি পদ এবং বাজার, বিপণিবিতান নির্মাণ ও সংস্কার শাখার রাজস্ব খাতে ১৪টিসহ মোট ১২৮টি পদের একটি প্রস্তাবনা স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ে পাঠায়।
অন্যদিকে ডিএনসিসি ‘ড্রেনেজ সার্কেল’ নামের একটি বিভাগে ২৬৫টি ও সিটি স্যানিটেশন সেলে ৬৯টি পদ তৈরির প্রস্তাব মন্ত্রণালয়ে পাঠায় গত অক্টোবরে। এরপর গত ১৪ মার্চ ডিএনসিসি ড্রেনেজ সার্কেলে ১৯৬টি এবং সিটি স্যানিটেশন সেলে ৬৬টি পদ তৈরির সংশোধিত প্রস্তাব পাঠায় স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ে। তবে এখনো তা চূড়ান্ত অনুমোদন হয়নি।
রিভার অ্যান্ড ডেল্টা রিসার্চ সেন্টারের (আরডিআরসি) চেয়ারম্যান মোহাম্মদ এজাজ বলেন, ‘ঢাকার খালগুলো শুধু হাতবদল হয়েছে। প্রকৃত অর্থে কোনো কাজই হয়নি। মালিকানা পাওয়ার পর প্রথম কাজ ছিল সীমানা নির্ধারণ করা। ডিএসসিসি কিংবা ডিএনসিসি পরিপূর্ণভাবে একটি খালের সীমানা নির্ধারণ করতে পারেনি। দুই সিটি করপোরেশন এখনো এমন একটি আদর্শ খাল তৈরি করতে পারেনি, যেখানে দখল-দূষণের কোনো অস্তিত্ব নেই। বিপরীতে খাল পরিষ্কার ও বিশেষ অভিযানের নামে কোটি কোটি টাকা খরচ হয়েছে।’
এবি/এইচএন