আলু উৎপাদনের অন্যতম জেলা জয়পুরহাটে এবার লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে তিন হাজার ৪৭০ হেক্টর বেশি জমিতে আলুর চাষ হয়েছে।
জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তথ্যমতে, চলতি মৌসুমে আলু চাষে লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছিল ৪০ হাজার হেক্টর জমি। আলু চাষ হয়েছে ৪৩ হাজার ৪৭০ হেক্টর জমিতে। কালাই উপজেলায় ১০ হাজার ৯০৫, ক্ষেতলালে নয় হাজার ২২০, পাঁচবিবিতে আট হাজার ৯৪৫, সদর উপজেলায় সাত হাজার ৮০০ ও আক্কেলপুরে ছয় হাজার ৬০০ হেক্টর জমিতে আলু চাষ হয়েছে।
অধিদপ্তরের তথ্যমতে, এবার আলু উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে নয় লাখ ৫৬ হাজার মেট্রিক টন। উৎপাদিত আলুর গড়ে ২৩ শতাংশ জেলার ১৯টি হিমাগারে সংরক্ষণ করা হবে। এতে করে প্রায় দুই লাখ মেট্রিকটনেরও বেশী আলু সংরক্ষণ হবে। এরইমধ্যে কিছু ব্যবসায়ী ও কৃষকরা সংরক্ষণ শুরু করেছেন। এখনও অর্ধেকের বেশি পরিমাণ আলু মাঠেই রয়েছে; যা ওঠাতে কমপক্ষে আরো এক সপ্তাহ সময় লাগবে। ফলে উৎপাদিত আলুর বেশির ভাগই হিমাগারে রাখার সুযোগ পাচ্ছেন না কৃষকরা। বাধ্য হয়ে তাদের কম দামে আলু বিক্রি করতে হচ্ছে। তাতে কৃষকরা আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন।
কৃষকদের অভিযোগ, মাঠ থেকে আলু ওঠানোর আগেই হিমাগারের স্লিপ শেষ হয় কীভাবে? ব্যবসায়ীরা হিমাগার মালিকদের সঙ্গে যোগাযোগ করে আগেই স্লিপ কেটে নিয়েছে। তবে হিমাগার মালিকরা বলছেন ভিন্ন কথা। আলু সংরক্ষণের জন্য সাধারণত দুই ধরনের বুকিং পদ্ধতি চালু রয়েছে। লুজ ও পেইড। যারা আগে আসবে তারাই বুকিং স্লিপ নিতে পারবেন। এখানে কৃষক ও ব্যবসায়ী বলতে কোনো পার্থক্য নেই। তারপরও এবার কৃষকদের অগ্রাধিকার দেওয়া হয়েছে। বাজারে আলুর দরপতন ঠেকাতে এবং পরবর্তী মৌসুমের জন্য বীজ আলু সংরক্ষণ করতে চাইলেও মজুতদার ও ব্যবসায়ীদের দৌরাত্ম্যে প্রকৃত কৃষকরা স্লিপ থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন বলে অভিযোগ উঠেছে। ফলে কৃষকরা সংরক্ষণ করতে না পেরে বাধ্য হয়ে কম দামে আলু বিক্রি করছেন; যা তাদের জন্য বড় ধরনের লোকসানের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। হিমাগার মালিকরা যদি মজুতদার ও ব্যবসায়ীদের অগ্রাধিকার দেন, তাহলে সাধারণ কৃষকরা সবসময় ক্ষতিগ্রস্ত হবেন। কৃষকরা সরকারের তদারকি বাড়িয়ে প্রকৃত কৃষকদের জন্য ন্যায্য সংরক্ষণের ব্যবস্থা করতে জোর দাবী জানান।
স্থানীয় বাজারগুলোতে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, প্রকারভেদে পাইকারী দামে কার্ডিনাল আলু ৫২০ থেকে ৫৭০ টাকায়, ডায়মন্ড আলু ৫০০ থেকে ৫২০ টাকায়, স্টিক আলু ৫০০ থেকে ৫২০ টাকায় ও দেশি আলু ৭০০ থেকে ৭৫০ টাকা পর্যন্ত বাজারে বিক্রয় করছেন কৃষকরা। এই আলু প্রতিমণ উৎপাদনে খরচ পড়েছে প্রায় সাড়ে ৫০০ থেকে ৬০০ টাকা। হিমাগারে খাবার আলু ও বীজ আলু সংরক্ষণ করতে না পারলে আরও লোকসান গুনতে হবে এমনটি দাবী করছেন স্থানীয় কৃষকরা।
গোপীনাথপুর হিমাগারে এসে সংরক্ষণের স্লিপ পাননি মামুদপুর গ্রামের কৃষক মাহবুব আলম। তিনি বলেন, ‘আমি বীজ ও খাওয়ার জন্য ৫০ বস্তা আলুর স্লিপ কাটতে এসে দেখি স্লিপ দেওয়া বন্ধ হয়েছে। এবার সংরক্ষণের সুযোগ পাচ্ছিনা। আমার মত অনেকেই এসে ঘুরে গেছে।
এবার আলু ব্যবসায়ীরা সব বুকিং স্লিপ আগেভাগেই নিয়ে গেছে। তাহলে আমরা অল্প করে হলেও কী বুকিং পাব না ?’ ব্যবসায়ী বেলাল হোসেন বলেন, ‘গত কয়েক বছর থেকে আলুর ব্যবসা করছি। এবছর দুটি হিমাগারে দুই হাজার ৫০০ বস্তা আলুর বুকিং দিয়েছি। আজ পর্যন্ত এক হাজার ৩০০ বস্তা আলু হিমাগারে সংরক্ষণ করেছি। আগামী সপ্তাহে আমার সংরক্ষণ শেষ হবে।’
শিয়ালমারী গ্রামের কৃষক মুকাব্বের হোসেন বলেন,‘পল্লী হিমাগারে গিয়ে দেখি কোনো স্লিপ নেই। তাহলে আমার এতোগুলো আলু কোথায় রাখবো? যদি সংরক্ষণ করতে না পারি, তাহলে তো অনেক লোকসান হবে। এ অবস্থায় মাথা ঠিক রাখতে পারছি না।’
হিমাগার সূত্রে জানা যায়, হিমাগারে আলু সংরক্ষণের জন্য সাধারণত দুই ধরনের বুকিং পদ্ধতি চালু রয়েছে, লুজ বুকিং ও পেইড বুকিং। লুজ বুকিং হলো, কৃষক বা ব্যবসায়ী আলু রাখার পর তা বিক্রি করে হিমাগারের ভাড়া পরিশোধ করেন। এবার প্রতিকেজির সংরক্ষণ খরচ ছয় দশমিক ৭৫ টাকা নির্ধারণ করেছে হিমাগার মালিক এসোসিয়েশন। আর পেইড বুকিং হলো, সংরক্ষণের আগেই পুরো টাকা পরিশোধ করতে হয়। তবে জয়পুরহাটের কোনো হিমাগারই এই পদ্ধতি অনুসরণ করে না। কৃষকদের অভিযোগ, হিমাগার মালিকরা প্রতিবছর ধারন ক্ষমতার বাইরে ২৫ থেকে ৩০ হাজার বস্তার বুকিং স্লিপ বেশী ছাড়ে। এবছর বেশী স্লিপও শেষ করেছে। মুলত হিমাগার মালিকরা মজুতদার ও ব্যবসায়ীদের কাছে স্লিপগুলো আগেই বিক্রি করে দিয়েছেন। যাতে করে প্রকৃত কৃষকরা স্লিপ না পেয়ে আলু বিক্রি করতে বাধ্য হন।
নর্থপোল কোল্ড স্টোরেজের ম্যানেজার মোনোয়ার হোসেন বলেন, ‘হিমাগারের ধারণ ক্ষমতা অনুযায়ী ৩৫ ভাগ ব্যবসায়ী ও মজুদদারদের জন্য রেখে বাকি ৬৫ ভাগ চাষীদের জন্য হিমাগার উম্মুক্ত রাখা হয়েছে। যারা আগে এসে স্লিপ নিয়েছেন তারাই কেবল আলু সংরক্ষণের সুযোগ পাচ্ছেন। এখন অনেকেই স্লিপ সংগ্রহ না করে ক্ষোভ প্রকাশ করছেন। আমরা নিরুপায়। ধারণ ক্ষমতার বেশি আলু সংরক্ষণ করতে পারি না।’
আক্কেলপুর উপজেলার তিলকপুর দীনা কোল্ড স্টোরেজের ব্যবস্থাপক সুপন বড়ুয়া বলেন, বিভিন্ন কারনে এই বছর শুরু থেকে কৃষকদের অগ্রাধিকার দিয়ে আলুর বুকিং নিয়েছি। বর্তমানে স্থানীয় ব্যবসায়ীদের বুকিং নিচ্ছি। বাজারে আলুর দাম কম থাকায় অন্যান্য বছরের তুলনায় এই বছর আলু সংরক্ষণের জন্য কৃষকদের চাহিদা চার গুন বেশি। তবে আমরা হিমাগারের নিকটবর্তী এলাকার কৃষকদের প্রাধান্য দিয়ে বুকিং নিয়েছি। বাইরের ব্যবসায়ীরা এবার অগ্রিম আলুর বুকিং কার্ড নিয়েছেন জানতে চাইলে তিনি বলেন, হিমাগারের সংরক্ষণে ব্যবসায়ীরাই প্রাণ। তারা আলু সংরক্ষণ না করলে শুধু কৃষকদের আলুতে হিমাগার ভরবে না। তবে বাইরের নয়, স্থানীয় ব্যবসায়ীরা অল্প করে অগ্রিম কার্ড নিয়েছেন। গত কয়েক বছর আলু রেখে লাভ হওয়ায় এবার কৃষকরা সংরক্ষণে ঝুকে পড়েছেন। তার ওপর বাজারে আলুর দাম কম এবং উৎপাদন বাম্পার হয়েছে।
পল্লী হিমাগারের ব্যবস্থাপক সাব্বির হোসেন বলেন, ‘প্রত্যেক চাষীর জন্য ৫০ বস্তা করে বুকিং চলমান আছে। আমরা এবার আগাম স্লিপ দেইনি। যে আগে আসবে, সেই আলু সংরক্ষণের সুযোগ পাবে। কোনো কারসাজি নেই।’
আলু ব্যবসায়ী মিঠু ফকির বলেন, ‘হিমাগার যখন ফাঁকা থাকে, তখন মালিকরা ব্যবসায়ীদের আলু রাখতে অনুরোধ করে। এবারের চিত্র একেবারেই আলাদা। বাজারে আলুর দাম কম হওয়ায় মূলত কৃষকরা এবার হিমাগারে সংরক্ষণে ব্যস্ত হয়ে ওঠেছে। তাদের পিড়াপিড়িতে এবার অনেক ব্যবসায়ীই আলু সংরক্ষণ করবেন না। আর কৃষকরা রাখলেও ব্যবসায়ীদের কোনো ক্ষতি নেই। তাদের নিকট থেকে আলু কিনে বাজার দর অনুযায়ী তারা সারাবছর ধরে বেচা-কেনা করবে।’
জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক মজিবুর রহমান বলেন, ‘সংরক্ষণের পর্যাপ্ত ব্যবস্থা না থাকলে কৃষকরা ভবিষ্যতে আলু চাষ কমিয়ে দেবেন। বিশেষ করে বীজ আলু সংরক্ষণের ব্যবস্থা না থাকলে পরবর্তী মৌসুমে আলুর উৎপাদন কমে যেতে পারে।’
আমারবাঙলা/ইউকে