বি. খন্দকার: আমাদের জন্মটাই কি শুধু লেখাপড়া করার জন্য? নিশ্চই না! লেখাপড়া করে কি লাভ হচ্ছে? দেশে ২৫ লক্ষ শিক্ষিত বেকার সার্টিফিকেট ধুয়ে পানি খাচ্ছে আগে সেগুলোর সমাধান করুক তারপর নতুন করে শিক্ষিত করার প্রোডাকশন শুরু হোক। নাহলে শিক্ষিতদের দুই টাকার মূল্য নেই যদি পকেটে টাকা না থাকে। একসময় পকেট খালি থাকলেও শিক্ষার মূল্য ছিলো কিন্তু এখন সেই জামানা আর নেই, বদলে গিয়েছে সমাজ ব্যবস্থা। এই টক্সিক সোসাইটির কাছে এখন টাকা ও ক্ষমতার কাছে অন্য কোনো কিছুই গ্রহণযোগ্য নয়। যার কাছে যতো বেশি টাকা আছে সমাজে তার কদর বেশি।
শিক্ষিত হয়ে কি করবেন? শিক্ষার মান যতো বাড়বে চুরির বিদ্যাও ততো বেশি বাড়বে কারণ শিক্ষিতরাই চুরি বেশি করে। শিক্ষার মান বাড়লেও ব্যক্তিগত সুবিধা আদায়ের জন্য পা চেটে গোলামীর অভ্যাস ও মন মানসিকতার পরিবর্তন আমাদের কোনোদিনও যাবেনা।
মানুষের আয় বাড়লে রাঘব বোয়ালদের গার্মেন্টস কারখানায় কে কাজ করবে? শিক্ষিত হয়ে কেউ কারো গার্মেন্টসে দৈনিক ১২ ঘন্টা করে মাসে ১২ হাজার টাকা বেতনের চাকরি করবেনা নিশ্চই। আমি যদি গার্মেন্টস কর্মী হতাম নিশ্চই আপনারাই কেউই আমাকে মানুষ হিসেবেও গণ্য করতেন না। আমরা উন্নত দেশগুলোর দিকে আঙ্গুল তুলে রেসিস্ট বলি অথচ আমরা কি জানি সবচেয়ে বড় রেসিস্ট তো আমরা নিজেরাই।
যারা নিজ জাতিকেই সম্মান দিতে জানেনা তারা আবার গরিব দেশ থেকে জীবিকার সন্ধানে এসে খেটে খাওয়া মানুষগুলোকে কিভাবে সম্মান করবে? আমরা রেমিটেন্সের জন্য সব ধরণের দরজা খুলে রেখেছি কিন্তু দেশ থেকে দেশের বাহিরে টাকা পাঠাতে গেলেই টাকা পাচার করা হচ্ছে বলে শুনতে হয়। এমন কি বিদেশ থেকে আসার সময় আমরা যেই ডলারগুলো দেশে এনে ভাঙিয়ে খরচ করি যাওয়ার সময় যদি কয়েকহাজার টাকা পকেটে অবশিষ্ট রয়ে যায় সেগুলো ঢাকা এয়ারপোর্টের অফিসারের কাছে রেখে যেতে হয়, যা সম্পূর্ণ তারা ভাগাভাগি করে নেয়।
বাংলাদেশের অর্থনীতির মেরুদন্ড হচ্ছে আর.এম.জি ও ফরেন রেমিট্যান্স যেটা গরিব শ্রমিকদের দ্বারাই জেনারেট করা সম্ভব। বছরের পর বছর সরকারি চাকরির আশায় বসে থাকা শিক্ষিত বেকারদের দ্বারা নয়।
সমাজে অবহেলিত খেটে খাওয়া শ্রমিকরাই আমাদের দেশের অর্থনীতির চাকা ঘুরাচ্ছে। একটা পার্সেন্টেন্জ নিম্ন আয়ের মানুষ না থাকলে এগ্রিকালচার ও আর.এম.জি সেক্টর সম্পূর্ণ রূপে বন্ধ হয়ে যাবে। গ্রামে খোঁজ নিয়ে দেখুন আজকাল ধান কাটার জন্য দৈনিক ১০০০ টাকা ও দুপুরে বোয়াল মাছের সাথে আনলিমিটেড ডাল ও ভাত দিয়েও ধান কাটার জন্য লেবার পাওয়া যাচ্ছেনা। কারণ নিত্যদিনের পণ্যের মূল্যের সাথে তাল মিলিয়ে তাদেরও জীবনের চাহিদা বেড়ে যাচ্ছে।
এখন আর আগের মতো কেউ শুধু খাদ্য ও কিছু টাকার বিনিময়ে কাজ চাইলেও করতে পারেনা। আগে মাসে দুই হাজার টাকার বিনিময়ে বাসায় সারামাস কাজ করাতে পেরেছেন কিন্তু এখন দশ হাজার টাকার বিনিময়েও কাউকে খুঁজে পাচ্ছেন না। বাসায় কাজের বুয়া রাখাটাই এখন মধ্যবিত্তদের নাগালের বাহিরে চলে যাচ্ছে। নিশ্চই কোনো শিক্ষিত মানুষ আপনার বাসার কাজ করবেনা যদি সে চরম মাত্রার বিপদে না পড়ে।
শুধুমাত্র শিক্ষা দিয়ে কখনোই অর্থনৈতিক ভাবে উন্নত হওয়া যায়না। জাপান, অস্ট্রেলিয়া, আমেরিকা বা কানাডায় গেলে বুঝতে পারবেন। একজন প্লাম্বার একজন ডাক্তারের চেয়েও বেশি ইনকাম করছে। অস্ট্রেলিয়া ও আমেরিকাতে খুব কম মানুষ দেখেছি যারা কলেজের বারান্দা পর্যন্ত গিয়েছে। তারা প্রতিটি কাজকে সম্মান করে বলেই তারা জাতি হিসেবে এতো উন্নত। আর আমরা বাঙালিরা ৩ বেলা ঠিকমতো ভাত পাইনা অথচ আমাদের রঙ তামাশার কোনো কমতি নেই এর জন্য আমরা বিশ্ব বাজার থেকে এতোটা পিছিয়ে পড়েছি।
হাতের কাজকে সম্মান ও মূল্যায়ন না করা পর্যন্ত এই অভাব ও বেকারত্ব আজীবন থাকবেই, কখনোই এই ছোট দেশে লক্ষ লক্ষ বেকারদের কর্মসংস্থান স্বয়ং সম্পূর্ণ করা সম্ভব হবেনা। শুধু বি.সি.এস এর ভাইরাসে আক্রান্ত না হয়ে হাতের কাজ শিখতে হবে, স্কিল অর্জন করতে হবে , তাহলে সেলফ এমপ্লয়ার ও সেলফ এমপ্লয়ীডদের সংখ্যা বাড়বে এবং অর্থনীতির উন্নয়ন দেখা দিবে।
স্কিল মানেই যে শুধু কম্পিউটার বেসড এর কাজ তা কিন্তু নয়। আপনার বাড়ির রঙের কাজ নিশ্চই কোনো শিক্ষিত বেকারকে দিয়ে করাবেন না কিংবা আপনার গাড়ির মেরামতের কাজও কোনো মাস্টার্স পাস্ করা বেকারকে দিবেন না। স্কিল মানেই যেকোনো ধরণের হাতের কাজ হতে পারে যেমন শেফ, অটোমোবাইল মেকানিক, ইলেক্ট্রিশিয়ান, সিকিউরিটি অফিসার, প্লাম্বার, কার্পেন্টার, ড্রাইভার, ব্রিক লেয়ার , কনস্ট্রাকশন ওয়ার্কার, সেলসম্যান, এমন ধরণের আরো শত শত পেশা আছে যেগুলো স্কিল না থাকলে কোনো শিক্ষিত বেকার দ্বারা সম্ভব নয়।
আমাদের দেশে সামাজিক অবক্ষয় ও অবস্থানের কারণে অফিসের কাজ ছাড়া আমরা কোনোভাবেই অন্য কোনো পেশাকে মেনে নিতে পারছিনা। অথচ উন্নত দেশে এসব স্কিল ওয়ার্কারদের ডিমান্ড ব্যাংক কর্মকর্তা বা সরকারি চাকরিজীবীদের থেকেও কয়েকগুন বেশি, এর মূল কারণ তারা দুই তিন বছর কাজ শিখে পরবর্তীতে নিজেদের ছোট প্রতিষ্ঠান খুলে নিজেরাই কাজ শুরু করে দেয়। এতে করে তারা তাদের কাজের স্বাধীনতা যেমন পাচ্ছে আবার চাকরিজীবীদের থেকেও দ্বিগুন বা তার অধিক কামাচ্ছে। ওখানে সরকারি চাকরি মানে পাবলিক সার্ভেন্ট, ভুল করলে পাবলিকের কাছে হিসেব দিতে হয়। সরকারি চাকরি বা পুলিশ এসবের পাত্তা দেয়ার সময় কারোরই নেই।
আমি বাস্তবে দেখেছি একজন ডাক্তারের স্বামী কনস্ট্রাকশন কোম্পানির লেবার, একজন উকিলের স্বামী রঙের মিস্ত্রি, একজন কর্পোরেটের হেড এর স্ত্রী কফির দোকানে কফি বানায় বাংলায় যাকে বলি চায়ের দোকানের কর্মচারী।
আপনারাকি আপনাদের সঙ্গী বা সঙ্গিনীর এসব পেশা মেনে নিতে পারবেন? কখনোই পারবেন না আর যতোদিন মানতে পারবেন না ততোদিন পর্যন্ত পরীক্ষায় ফেল করলে আত্মহত্যা ও লক্ষ লক্ষ শিক্ষিত বেকারদের কর্মসংস্থান কোনোদিনও হবেনা এবং এটা সম্ভবও নয়।
কারণ আপনার বেকারত্ব ও কর্মসংস্থানের জন্য দেশ ও সরকার নয় এই বিষাক্ত সমাজ এবং আপনি নিজেই দায়ী। নিজেকে পরিবর্তন করুন এবং সমাজকেও পরিবর্তনের সুযোগ দিন কারণ বেকার আপনার ঘরেও আছে। ধন্যবাদ।
লেখক:
প্রতিষ্ঠাতা ও সভাপতি
ইউনাইটেড গ্লোরি অব বাংলাদেশ (ইউজিবি)