নিজস্ব প্রতিবেদক: প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা ২০২৪-২৫ অর্থবছরের জাতীয় বাজেট সম্পর্কে বলেছেন, সরকার বর্তমান বিশ্ব পরিস্থিতি মাথায় রেখে রক্ষণশীল উপায়ে এগিয়ে যাওয়ার মাধ্যমে জনগণের মৌলিক অধিকারগুলো পূরণের লক্ষ্যেই এ বাজেট প্রণয়ন করেছে।
তিনি বলেন, “বিশ্ব পরিস্থিতি মাথায় রেখেই কিন্তু আমাদের পরিকল্পনা নিয়ে চলতে হবে। আমরা সীমিতভাবে এবং খুব সংরক্ষিতভাবে এগোতে চাই যাতে দেশের মানুষের কষ্টটা না হয় এবং মানুষের যে প্রয়োজন সেটা আমরা মেটাতে চাই। সেদিকে লক্ষ্য রেখেই সেভাবেই আমরা বাজেট করেছি।”
প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা আজ বিকেলে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ কার্যালয়, তেজগাঁওয়ে ঐতিহাসিক ‘৬ দফা’ দিবস উপলক্ষ্যে দলের পক্ষ থেকে আয়োজিত আলোচনা সভায় সভাপতিত্বকালে দেওয়া ভাষণে একথা বলেন।
কোভিড-১৯ পরবর্তী বিশ্বের বিভিন্ন স্থানে যুদ্ধ পরিস্থিতির কারণে সৃষ্ট বিশ^ অর্থনৈতিক মন্দার ছোবলে আমদানী পণ্যের মূল্যবৃদ্ধিতে দেশের দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির উল্লেখ করে তিনি বলেন, মূল্যস্ফীতির কারণে উন্নত দেশগুলোই হিমশিম খাচ্ছে।
তিনি বলেন, আমরা সীমিতভাবে এবং খুব সংরক্ষিতভাবে এগোতে চাই যাতে দেশের মানুষের কষ্টটা না হয় এবং মানুষের যে প্রয়োজন সেটা আমরা মেটাতে চাই। সেদিকে লক্ষ্য রেখেই সেভাবে আমরা বাজেট করেছি। এখন মূল্যস্ফীতি যদিও বেশি তথাপি চাল উৎপাদনই আমরা চারগুণ বাড়িয়েছি। মাছ, মাংস, ডিম প্রত্যেকটি জিনিষেরই আমরা উৎপাদন বাড়িয়েছি। উৎপাদন যেমন বেড়েছে মানুষের আর্থিক স্বচ্ছলতাও বেড়েছে, পাশাপাশি মানুষের খাদ্য গ্রহণের পরিমানও বেড়েছে।
গতকাল তাঁর সরকারের বাজেট ঘোষণার উল্লেখ করে সরকার প্রধান বলেন, বিএনপি’র আমলে মাত্র ৬২ হাজার কোটি টাকার বাজেট ছিল, আর তত্ত্বাবধায়ক সরকার বোধ হয় ৬৮ হাজার কোটি টাকার বাজেট দিয়ে গিয়েছিল। সেখানে আমরা ৭ লাখ ৯৭ হাজার কোটি টাকার বাজেট দিতে সক্ষম হয়েছি।
তিনি বলেন, এই বাজেটে এবার মানুষের মৌলিক অধিকারগুলোকে নিশ্চিত করার জন্য শিক্ষা, স্বাস্থ্য, কৃষি, দেশীয় শিল্প, সামাজিক নিরাপত্তা-এগুলোকে সব থেকে বেশি প্রাধান্য দেওয়া হয়েছে যা মানুষের জীবন যাত্রা উন্নত করবে।
মূল্যস্ফীতিতে সীমিত আয়ের সাধারণ মানুষদের কষ্ট হচ্ছে উল্লেখ করে সরকার প্রধান বলেন, সরকার তাদের নিত্য প্রয়োজনীয় পণ্য সুলভে ক্রয়ের জন্য পারিবারিক কার্ড করে দিয়েছে এবং হতদরিদ্রদের বিনা পয়সায় খাবার দিচ্ছে। দেড় শতাধিক সামাজিক নিরাপত্ত বলয়ের কর্মসূচির মাধ্যমে মানুষকে আর্থিক সহায়তা প্রদান করছে। বিনা পয়সায় বই, বৃত্তি-উপবৃত্তি প্রদান এবং কমিউনিটি ক্লিনিকের মাধ্যমে ৩০ প্রকারের ওষুধ বিনামূল্যে প্রদান করা হচ্ছে।
তিনি বলেন, বোরো ধান উঠার পর সাম্প্রতিক প্রাকৃতিক দুর্যোগে ক্ষেতের ফসল নষ্ট হয়েছে, এখন কৃষক আবার যেন জমিগুলো চাষ করতে পারে সে উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে। ঝড়-বৃষ্টি, বন্যা আবারও আসতে পারে, সেগুলো মোকাবিলা করে মানুষের চাহিদা পূরণে পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে।
তিনি এ সময় দেশের প্রতি ইঞ্চি অনাবাদি জমিকে চাষের আওতায় আনার মাধ্যমে উৎপাদন বাড়ানোর জন্য এবং সকলকে বৃক্ষ রোপনে এগিয়ে আসার জন্য তাঁর আহবান পুনর্ব্যক্ত করেন । কৃষক লীগ বৃক্ষরোপনের দায়িত্বে থাকলেও আওয়ামী লীগের প্রতিটি সহযোগী সংগঠনকেও তিনি এ ব্যাপারে দৃষ্টি দেওয়ার আহবান জানান।
তিনি বলেন, এখন সব থেকে বড় চ্যালেঞ্জ হচ্ছে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রন করা। বিশেষ করে খাদ্য মূল্য। সেখানে উৎপাদন ও সরবরাহ বৃদ্ধি করতে হবে।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, বিশ্ব পরিস্থিতি মাথায় রেখেই কিন্তু আমাদের পরিকল্পনা নিয়ে চলতে হবে। আলোচনা সভার মঞ্চে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এবং সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রী ওবায়দুল কাদের উপস্থিত ছিলেন।
আওয়ামী লীগের সভাপতি মন্ডলীর সদস্য শেখ ফজলুল করিম সেলিম এমপি, শাজাহান খান এমপি, এডভোকেট কামরুল ইসলাম এমপি এবং ডা. মোস্তফা জালাল মহিউদ্দিন অনুষ্ঠানে বক্তৃতা করেন।
আরো বক্তৃতা করেন আওয়ামী লীগের মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক সম্পাদক এডভোকেট মৃণাল কান্তি দাস, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিষয়ক সম্পাদক ইঞ্জিনিয়ার মো.আব্দুস সবুর এমপি, দলের কার্যনির্বাহী সদস্য এডভোকেট সানজিদা খানম এমপি, ঢাকা মহানগর আওয়ামী লীগ উত্তর ও দক্ষিণের সাধারণ সম্পাদক এস এম মান্নান কোচি এবং হুমায়ুন কবির।
আওয়ামী লীগের প্রচার ও প্রকাশনা সম্পাদক ড. আব্দুস সোবহান গোলাপ এবং উপ প্রচার সম্পাদক আব্দুল আওয়াল শামীম সভাটি সঞ্চালনা করেন।
বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ ১৯৬৬ সালের ৭ জুন সমগ্র পূর্ব পাকিস্তানে জনগণের ওপর পাকিস্তানের তৎকালীন কেন্দ্রীয় সরকারের শোষণ, বঞ্চনা, পরাধীনতা ও অত্যাচারের অবসান ঘটাতে স্বায়ত্তশাসনের দাবিতে ঘোষিত ৬ দফা দাবির পক্ষে দিনব্যাপী হরতালের ডাক দেয় এবং দেশব্যাপী তীব্র গণআন্দোলনের সূচনা হয়।
হরতাল চলাকালে ঢাকা, টঙ্গী ও নারায়ণগঞ্জে সেদিন বিক্ষোভকারীদের ওপর পুলিশ ও আধাসামরিক ইস্ট পাকিস্তান রাইফেলস (ইপিআর) গুলি চালালে শ্রমিক নেতা মনু মিয়া, শফিক ও শামসুল হকসহ অনেকে শহীদ হন।
উল্লেখ্য, ৬ দফা মূলত স্বাধীনতার এক দফা ছিল। ৬ দফার মধ্যেই স্বাধীনতার বীজ নিহিত ছিল।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, আজকে ঐতিহাসিক ৬ দফা দিবস। এই ৬ দফাই ছিল বাঙালি জাতির জন্য ‘ম্যাগনা কার্টা’। এই জাতিকে বঞ্চনা থেকে মুক্তির জন্য জাতির পিতার দেওয়া ৬ দফার মধ্যদিয়েই আমরা অর্জন করেছি স্বাধীনতা। এই ৬ দফার মাধ্যমেই ১৯৭০ সালের নির্বাচনে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ নিরঙ্কুশ বিজয় অর্জন করেছিল।
জাতির পিতা ৬ দফার পক্ষে সারাদেশে ৩২ দিনে ৩৫টি মিটিং করেন এবং আওয়ামী লীগকে সারাদেশে শক্তিশালী করেন, সে সময় ৮টি জেলায় তাঁকে গ্রেফতার করা হয় উল্লেখ করে তিনি বলেন, ফলে এই ৬ দফাকে মানুষ লুফে নেয়।
বাঙালির মুক্তি সংগ্রামের প্রতিটি অধ্যায়ের মত ৬ দফার ক্ষেত্রেও তাঁর মা বঙ্গমাতার ভূমিকা তুলে ধরে তাঁর কন্যা বলেন, ৭ জুনের এই হরতাল করার জন্য সবথেকে সক্রিয় ছিলেন আমার মা। বঙ্গবন্ধু কারাগারে থাকায় বঙ্গমাতা ছাত্রনেতা ও আওয়ামী লীগের নেতাদের দেখা করা, ছাত্র আন্দোলন গড়ে তোলা, শ্রমিক নেতাদের সঙ্গে কথা বলা ও আন্দোলন গড়ে তোলার মতো সব কাজগুলো ইন্টেলিজেন্সের চোখ ফাঁকি দিয়ে অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে করেছিলেন।
তিনি বলেন, “আমার মা’তো বড় গেরিলা ছিলেন।”
তিনি বলেন, ৭ জুন আদমজীর থেকে মিছিল করে শ্রমিকরা চলে এসেছিল। যেখানে গুলি চালানো হলে তেজগাঁওয়ের শ্রমিক নেতা মনু মিয়াসহ ১১ জন মানুষ মৃত্যুবরণ করে। বাঙালি তার প্রতিটি অর্জন বুকের তাজা রক্ত দিয়ে, সংগ্রামের মধ্য দিয়েই আদায় করেছে।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, আওয়ামী লীগ প্রমাণ করেছে যে জাতির পিতার হাতে গড়া মাঁটি ও মানুষের এই সংগঠনটি ক্ষমতায় গেলেই মানুষের ভাগ্যের পরিবর্তন হয়, তাদের ভাগ্যের দুয়ার খুলে যায়।
বাজেটে মানুষের যেটা প্রয়োজন তার ওপর থেকে সরকার ট্যাক্স কমিয়ে দিয়েছে উল্লেখ করে সরকার প্রধান বলেন, খাদ্য পণ্য, চিকিৎসা ক্ষেত্র, ক্যান্সার বা ডায়ালাইসিস এ সমস্ত জিনিষের ওপর থেকে ট্যাক্স কমিয়ে দিয়ে একদিকে স্বাস্থ্যসেবা, একদিকে কৃষি উৎপাদন, খাদ্য নিরাপত্তা, দেশিয় শিল্পকে প্রাধান্য দেওয়া, দেশিয় শিল্প উৎপাদনের ক্ষুদ্র যন্ত্রাংশ ও কাঁচামাল - সেগুলাকে সীমিতভাবে সুরক্ষা দেওয়া হয়েছে। সেভাবেই অত্যন্ত পরিকল্পিতভাবে আমাদের বাজেটটা আমরা দিয়েছি।
এরফলে ল্যাপটপের দাম কমবে, ক্যান্সারের ওষুধের দাম কমবে, ক্ষুদ্র-মাঝারি যন্ত্রাংশের ট্যাক্স কমানোর ব্যবস্থা আমরা নিয়েছি, বলেন তিনি।
কালো টাকা সাদা করার বিষয়ে তিনি বলেন, উদ্বৃত্ত টাকাটা পথে আসুক তারপরতো ট্যাক্স দিতেই হবে। এটা আগেই শুরু হয়েছিল এবং প্রত্যেক সরকারই করে। আমরাও সুযোগটা দিয়েছি যাতে টাকা কেউ গুঁজে না রেখে অল্প ট্যাক্স দিয়ে ব্যাংকে নিয়ে আসে। অন্তত টাকাটা যাতে উদ্ধার হয় সে ব্যবস্থাই নেওয়া হয়েছে। যদিও এটা নিয়ে নানাজনের নানা কথা শোনা যাচ্ছে।
তিনি বলেন, আমি জানি করোও ভালো লাগে, কারো ভালো লাগে না, আমাদের দেশেতো রয়েছেই যাদের কিছুই ভালো লাগবে না। বাজেট ঘাটতি নিয়েও অনেকে কথা বলেন, আমি সরকারের আমার পর এটা ২১ তম বাজেট দিলাম যেখানে সবসময় আমরা ৫ শতাংশের মত বাংলাদেশে বাজেট ঘাটতি রাখি। এবারও ৪ দশমিক ৬ শতাংশ রাখা হয়েছে। তিনি আমেরিকাসহ বিশ্বের অন্যান্য উন্নত দেশে খোঁজ নিতে বলেন, সে সব দেশের বাজেট ঘাটতি কত থাকে। উন্নত দেশেও এরচেয়ে বেশি বাজেট ঘাটতি থাকে। আমরা একটা হিসাব রেখে যত অসুবিধাই হোক সেটা অব্যাহত রাখছি।
তিনি বলেন, কিছু ভালো না লাগা গ্রুপ তাদের ভালো না লাগা নিয়েই থাক, ওদিকে কান দেওয়ার দরকার নেই। কারণ এটা যুগ যুগ ধরেই দেখছি তাদেও এই মনভাব নতুন কিছু নয়। আর কোন অস্বাভাবিক সরকার আসলেই কেবল তারা খুশি হয়। কেননা তাদের গুরুত্ব থাকে। জনগণের ভোটে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসলে তাদের নাকি মূল্যায়নই হয় না।
মূল্যায়নের মাপকাঠিটা কি হবে সে প্রশ্ন তুলে প্রধানমন্ত্রী বলেন, কেয়ারটেকার সরকারের সময় আমরা দেখেছি তাদের চরিত্র। অগণতান্ত্রিক সরকার ক্ষমতায় আসলে কিভাবে তেল মারে। কাজেই আমাদের ঐ তেলমারা গোষ্ঠীর দরকার নাই।
আওয়ামী লীগ সভাপতি বলেন, আমাদের আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মী যে যেখানে আছেন প্রত্যেককেই এটা স্মরণ রাখতে হবে যে আওয়ামী লীগের একমাত্র শক্তি হচ্ছে জনগণ। অনেক জায়গা অনেক খেলা খেলতে চেষ্টা করেছে কিন্তু জনগণ আমাদের ওপর আস্থা রেখেছে, বিশ্বাস রেখেছে এবং তাদের ভোটেই আমরা জয়ী হয়ে সরকার গঠন করে আগে একবারসহ একটানা এই চতুর্থবার ক্ষমতায় আছি। যে কারণে বিশে^ আজ বাঙালি জাতি সম্মান নিয়ে চলতে পারে।
তিনি আরো বলেন, “আজকের বাংলাদেশকে উন্নয়নের রোল মডেল বলা হয়। মানুষের এই আস্থা ও বিশ্বাস নিয়েই উন্নয়নশীল দেশ থেকে উন্নত সমৃদ্ধ দেশের পথে এগিয়ে যাবে বাংলাদেশ”।
এবি/এইচএন