দূর থেকে প্রথম দেখায় যে কেউ ভাববে এটি একটি বিমান। ভুল নয়, এটি বিমানই। তবে সব বিমানের মতো নয়। এর ভেতরে সহজাত যাত্রী পরিবহনের কোনো আসন নেই। মূল কথা পুরো বিমানটি একটি হাসপাতাল। চক্ষুর জন্য বিষেশায়িত হাসপাতাল।
সরেজমিন দেখা যায়, বিমানের মধ্যেই রয়েছে চক্ষু চিকিৎসার নানা আয়োজন। একটি বিশেষায়িত চক্ষু হাসপাতালের জন্য যেসব চিকিৎসা সরঞ্জাম প্রয়োজন, তার সবই রয়েছে বিমানটিতে। রয়েছে হৃৎস্পন্দন, রক্তচাপ, অক্সিজেন, স্যাচুরেশন, রেটিনাসহ নানা পরীক্ষা-নিরীক্ষার ব্যবস্থা। অস্ত্রোপচারের জন্য রয়েছে আধুনিক অপারেশন থিয়েটার। জটিল রোগী ব্যবস্থাপনায় নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রও স্থাপন করা হয়েছে।
এসবই আছে বিমানে স্থাপিত বিশ্বের প্রথম ও একমাত্র ‘অরবিস উড়ন্ত চক্ষু হাসপাতালে’। স্বাস্থ্য ও পরিবারকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের আমন্ত্রণে যুক্তরাষ্ট্রের দাতব্য সংস্থা অরবিস ইন্টারন্যাশনালের বিমানটি গত ১৪ নভেম্বর চট্টগ্রাম শাহ আমানত আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে অবতরণ করে। বিমানে চক্ষু পেশাজীবীদের বিশেষ প্রশিক্ষণের সুযোগ মিলবে। গত রবিবার থেকে প্রশিক্ষণ শুরু হয়েছে। চলবে ২৮ নভেম্বর পর্যন্ত। চিকিৎসক ও স্বাস্থ্যকর্মী মিলে ১৫০ জনকে বিশেষ প্রশিক্ষণ দেওয়া হবে।
চট্টগ্রাম শাহ আমানত আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের ভিআইপি গেট দিয়ে প্রবেশ করতেই দেখা মেলে বিশাল আকৃতির এমডি-১০ বিমানটি। সাধারণত এই ধরনের বিমান চারশ যাত্রী বহন করতে পারে। তবে এই বিমানটির ভেতরে যাত্রীর বসার জন্য কোনো আসন নেই। বিমানের মধ্যে হাসপাতালের আদলে চারটি কক্ষ তৈরি করা হয়েছে। একেকটি কক্ষে পাঁচ-ছয় জন চিকিৎসক ও স্বাস্থ্যকর্মীকে চক্ষু চিকিৎসা ও সার্জিক্যাল প্রশিক্ষণ দেওয়া হচ্ছে।
এক কক্ষে প্রশিক্ষণরত চট্টগ্রাম চক্ষু হাসপাতাল ও প্রশিক্ষণ কেন্দ্রের চক্ষু চিকিৎসক তামান্না মোরশেদ বলেন, চোখের অনেক বিষয়ে আমরা শুধু বইয়ে পড়েছি। এখানে অত্যাধুনিক যন্ত্রের সহযোগিতায় হাতে-কলমে জানার সুযোগ মিলছে। এই প্রশিক্ষণ কর্মজীবনে নতুন মাত্রা যোগ করবে। এখান থেকে যন্ত্র পরিচালনার দক্ষতা অর্জন করতে পারব বলে আশা করি।
আরেক চিকিৎসক শহিদুল ইসলাম বলেন, অত্যাধুনিক যন্ত্র ও প্রযুক্তির মাধ্যমে এই প্রশিক্ষণ দেওয়ায় এটি নিয়ে পেশাজীবীদের আগ্রহ ব্যাপক। তবে সবাই এই প্রশিক্ষণের সুযোগ পান না। অনলাইনে পাঁচটি পরীক্ষা দিয়ে নির্বাচিতরা এই প্রশিক্ষণের সুযোগ পান। প্রশিক্ষণে ব্যবহৃত যন্ত্রগুলোর অধিকাংশ বাংলাদেশের হাসপাতালে নেই। কিছু সরকারি হাসপাতালে এসব যন্ত্র থাকলেও চিকিৎসকদের ব্যবহারে দক্ষতা নেই।
বিমানে একটি বিশাল কক্ষ রয়েছে, যেখানে একসঙ্গে ৫০ জন ক্লাস করতে পারবেন। অনলাইনের এই ক্লাসেও দেশের বিভিন্ন হাসপাতালের চিকিৎসকরা যুক্ত হন। শুধু প্রশিক্ষণ নয়, নির্বাচিত ১০০ রোগীকে চিকিৎসা দেওয়া হবে। একটি কক্ষ তৈরি করা হয়েছে অস্ত্রোপচারের জন্য। একটি হাসপাতালের অস্ত্রোপচার কক্ষে যেসব সরঞ্জাম থাকে, তার সবই রয়েছে এখানে।
অরবিস ইন্টারন্যাশনাল যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক একটি আন্তর্জাতিক অলাভজনক সংস্থা। এটি বিশ্বের ২০০টির বেশি দেশ ও অঞ্চলে দৃষ্টি সুরক্ষা কার্যক্রম পরিচালনা করে। বিমানটি এরই মধ্যে ৯৫টি দেশে ভ্রমণ করেছে। সর্বশেষ মঙ্গোলিয়ায় প্রশিক্ষণ কার্যক্রম পরিচালনা শেষে বাংলাদেশে এসেছে। পরের গন্তব্য রোমানিয়া।
অরবিস ইন্টারন্যাশনালের কান্ট্রি ডিরেক্টর মুনির আহমেদ বলেন, এই কার্যক্রমের উদ্দেশ্য চোখের সেবার মান বাড়াতে স্থানীয় চক্ষু পেশাজীবীদের দক্ষ করে গড়ে তোলা ও চোখের স্বাস্থ্য সম্পর্কে সচেতনতা বাড়ানো। চোখের ছানি, রেটিনার ক্যানসার, গ্লুকোমা, অকুলোপ্লাস্টি এবং কর্নিয়া রোগের চিকিৎসা ও প্রশিক্ষণ দিচ্ছে অরবিস। মূলত অন্ধত্ব প্রতিরোধ করা আমাদের লক্ষ্য। অরবিস ইন্টারন্যাশনাল ১৯৮৫ সাল থেকে ১১ বার দেশের প্রায় এক হাজার ৮০০ চক্ষু পেশাজীবীকে প্রশিক্ষণ দিয়েছে। অরবিসের সহযোগিতায় বাংলাদেশের চিকিৎসকরা দেশেই বিশ্বমানের চক্ষুসেবা নিশ্চিত করতে পারছেন।
অরবিস ইন্টারন্যাশনালের প্রেসিডেন্ট ও সিইও ডেরেক হডকি বলেন, আমাদের লক্ষ্য চোখের শক্তিশালী এবং টেকসই চিকিৎসা ব্যবস্থা গড়ে তোলা। এ প্রশিক্ষণ বাংলাদেশের চোখের চিকিৎসা ব্যবস্থাকে উন্নত করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে।
আমারবাঙলা/এমআরইউ