প্রকৃতির অমোঘ নিয়মে মহাকালের গর্ভে হারিয়ে গেল আরেকটি বছর। শুরু হল নতুন খ্রিষ্টীয় বর্ষ ২০২৫। ঝরা পল্লবের মতো গ্রেগরিয়ান ক্যালেন্ডারের পাতা থেকে ইতোমধ্যে খসে পড়েছে ২০২৪। ফেলে আসা বছরটি এখন ‘পুরোনো সেই দিনের কথা’। নববর্ষকে আহ্বান জানানোর মাধ্যমে ফুরালো গত বছরের সব লেনদেন। বিদায় ২০২৪। দুঃখ-বেদনা ভুলে নতুন আশায় ও স্বপ্নে স্বাগত ২০২৫ সালকে।
যেদিন গেছে, তা হোক সফলতার কিংবা ব্যর্থতার। অতীত থেকে শিক্ষা নিয়ে আগামী দিনগুলো আলোকিত হবে নির্ভুলভাবে। ‘আমার যাবার সময় হলো, দাও বিদায়। মোছ আঁখি, দুয়ার খোলো, দাও বিদায়’... জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের এ গানের সুর ধরেই যেন বিদায়ের বার্তা নিয়ে নতুনের আবাহনে বিলীন ২০২৪। নতুন আলোর প্রত্যয়ে স্বাগত ২০২৫।
পৃথিবীর নানা প্রান্তে ভিন্ন ভিন্ন আয়োজনের মাধ্যমে ৩১ ডিসেম্বর রাত ১২টা ১ মিনিটে যাত্রা শুরু করে নববর্ষ-২০২৫। পুরোনো বছর পেছনে ফেলে নতুন বছরকে বরণ করে নেওয়ার ঊষালগ্নে জমকালো আয়োজনে মেতে ওঠে বিভিন্ন দেশ, দেশের মানুষ, যা ‘থার্টি ফার্স্ট নাইট’ নামে পরিচিত। থার্টি ফার্স্ট নাইটের ছোঁয়া পৃথিবীর নানা দেশের মতো আমাদের লেগেছে সমানভাবে।
বিদায়ী বছর ২০২৪ সালের সকল দুঃখ বেদনা ভুলে গিয়ে এবং নতুন বছরের নতুন আশা-আকাঙ্ক্ষা ও উদ্দীপনা নিয়ে বিশ্ববাসীর সঙ্গে নানা কর্মসূচির মাধ্যমে মঙ্গলবার (৩১ ডিসেম্বর) দিবাগত মধ্যরাতে পালিত হচ্ছে ‘থার্টি ফার্স্ট নাইট’। সকল শ্রেণী-পেশার মানুষ, বিশেষ করে যুব সমাজ মধ্যরাতে ১২ টা ১ মিনিট বাজার সঙ্গে সঙ্গে নববর্ষের বিভিন্ন কর্মসূচি উদযাপনে মেতে উঠে।
এদিকে রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিন এবং অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস পৃথক বাণীতে ইংরেজি নববর্ষ ২০২৫ উপলক্ষ্যে দেশবাসীকে শুভেচ্ছা জানিয়েছেন। এ ছাড়া, ইংরেজি নববর্ষ উপলক্ষ্যে দেশের মানুষ ইতোমধ্যে বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ও অন্যান্য বার্তা পাঠানোর মাধ্যমে তাদের প্রিয়জন ও বন্ধু-বান্ধবদের শুভকামনা জানাচ্ছেন।
বাণীতে রাষ্ট্রপতি বলেন, ‘জুলাই-আগস্টের ছাত্র-শ্রমিক-জনতার অভ্যুত্থান পরবর্তী বর্তমান প্রেক্ষাপটে নতুন বছর আমাদের মাঝে বয়ে এনেছে এক নতুন সুযোগ ও সম্ভাবনা। বিরাজমান বৈশ্বিক অর্থনৈতিক মন্দা পরিস্থিতিতে আমি আশা করি, সচ্ছল সমাজ ও রাষ্ট্র দুস্থ, অসহায় ও পশ্চাদপদ মানুষের সহায়তায় এগিয়ে আসবে। নববর্ষ উদযাপন একজনের আনন্দ যেন অন্যদের বিষাদের কারণ না হয় আমরা সেদিকেও খেয়াল রাখবো।’
বাণীতে ড. মুহাম্মদ ইউনূস বলেন, ‘নতুনের আগমনী বার্তা আমাদের উদ্বেলিত করে, নব উদ্যমে সুন্দর আগামীর পথচলার জন্য অনুপ্রেরণা যোগায়। নতুন বছরের এই মাহেন্দ্রক্ষণে সকল চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করে নতুন সম্ভাবনাকে কাজে লাগিয়ে উন্নতির নতুন শিখরে আরোহণে অঙ্গীকারবদ্ধ বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকার।’ প্রধান উপদেষ্টা বলেন, ‘ছাত্র-শ্রমিক-জনতার গণঅভ্যুত্থানের মাধ্যমে গঠিত অন্তর্বর্তীকালীন সরকার লাখো শহীদের রক্ত ও গত জুলাই-আগস্ট মাসে ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে অর্জিত স্বাধীনতাকে সর্বদা সমুন্নত রাখার অঙ্গীকার করছে। আমরা দেশকে ভালোবাসবো, দেশের মানুষের সার্বিক কল্যাণে সর্বশক্তি নিয়োগ করবো এবং যেকোনো সন্ত্রাসবাদকে প্রতিহত করবো।’
জাতীয় জীবনে ২০২৪ বিদায়ী বছরটি নানা দিক থেকে গুরুত্বপূর্ণ। রাজনৈতিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক, শিক্ষাসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে ২০২৪ ছিল ঘটনাবহুল। চ্যালেঞ্জ এসেছে, নানা ঘটনাও ঘটেছে। ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ক্ষমতাচ্যুত হয়ে ভারতে চলে যান। তিনদিন কার্যত দেশ ছিল সরকারবিহীন। ৮ আগস্ট নোবেলজয়ী অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তী সরকার গঠিত হয়। বাংলাদেশের মানুষ নতুন আশায়, নতুন স্বপ্নের প্রত্যয়ে বুক বাধে।
যেভাবে এলো ইংরেজি নববর্ষ
বিশ্বব্যাপী পালিত নানা জাতিগোষ্ঠীর উৎসবগুলোর মধ্যে সর্বাপেক্ষা প্রাচীন হিসেবে মনে করা হয় বর্ষবরণ উৎসবকে। তাই বর্ষবরণের এই প্রাচীনতা ঐতিহ্যের ধারক। পৃথিবীর সব দেশ ও জাতির মধ্যেই নববর্ষ পালনের রীতি বিদ্যমান। আন্তর্জাতিকভাবে খ্রিষ্টীয় বা ইংরেজি নববর্ষ পালনের গুরুত্ব অপরিসীম।
জানুয়ারির ১ তারিখ থেকে শুরু হয় নতুন বছর আধুনিক গ্রেগরিয়ান ক্যালেন্ডার ও জুলিয়ান ক্যালেন্ডার অনুযায়ী। খ্রিষ্টপূর্ব ২০০০ অব্দে ইংরেজি নতুন বছর উদযাপনের ধারণাটি আসে, তখন মেসোপটেমিয় সভ্যতার (বর্তমান ইরাক) লোকেরা নতুন বছর উদ্যাপন শুরু করে। তারা তাদের নিজস্ব গণনা বছরের প্রথম দিন নববর্ষ উদযাপন করত।
খ্রিষ্টপূর্ব ১৫৩ সালে রোমে নতুন বছর পালনের প্রচলন শুরু হয়। পরে খ্রিষ্টপূর্ব ৪৬ অব্দে সম্রাট জুলিয়াস সিজার একটি নতুন বর্ষপঞ্জিকার প্রচলন করেন। যা জুলিয়ান ক্যালেন্ডার নামে পরিচিত। রোমে জুলিয়ান ক্যালেন্ডারের অন্তর্গত বছরের প্রথম দিনটি জানুস দেবতার উদ্দেশ্যে উৎসর্গ করা হয়। জানুস প্রবেশপথ বা সূচনার দেবতা। তার নাম অনুসারেই বছরের প্রথম মাসের নাম জানুয়ারি করা হয়।
এগুলো যিশুর জন্মের আগের কথা। তবে যিশু খ্রিষ্টের জন্মের পর তার জন্মের বছর গণনা করে ১৫৮২ সালে পোপ ত্রয়োদশ গ্রেগরি ক্যালেন্ডারের নতুন সংস্কার করেন। যা গ্রেগরিয়ান ক্যালেন্ডার নামে পরিচিত। বর্তমানে বিশ্বের বেশিরভাগ দেশেই কার্যত দিনপঞ্জি হিসেবে গ্রেগরিয়ান ক্যালেন্ডার অনুসরণ করা হয়। তবে আনুষ্ঠানিকভাবে নতুন বছর পালন শুরু হয় ১৯ শতক থেকে। নতুন বছরের আগের দিন অর্থাৎ ৩১ ডিসেম্বর হচ্ছে ‘নিউ ইয়ার ইভ’। এদিন নতুন বছরের আগমনে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে বিরাজ করে উৎসবমুখর পরিবেশ।
যদিও ইংরেজি নতুন বর্ষ পালনে ব্যতিক্রমও রয়েছে। যেমন- ইসরায়েল দেশটি গ্রেগরিয়ান ক্যালেন্ডার অনুসরণ করলেও ইংরেজি নববর্ষ পালন করে না। আবার কিছু দেশ গ্রেগরিয়ান ক্যালেন্ডারকে গ্রহণই করেনি। এদের মধ্যে আছে ইরান, ইথিওপিয়া, আফগানিস্তান সৌদি আরব, নেপাল। এসব দেশও ইংরেজি নববর্ষ পালন করে না।
বিদায় ২০২৪: একতরফা নির্বাচন, ছাগলকাণ্ড, শেখ হাসিনার দেশত্যাগসহ অনেক ঘটনা
বাংলাদেশের সাম্প্রতিক ইতিহাসে সবচেয়ে ঘটনাবহুল এক বছর ২০২৪। সাড়ে তিন দশকে দ্বিতীয়বারের মতো অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে সরকার পতনের ঘটনা ঘটলো। তবে, স্বাধীন বাংলাদেশের ইতিহাসে ক্ষমতায় থাকা কোনো সরকারপ্রধানের আন্দোলনের মুখে দেশ ত্যাগ করে অন্য দেশে আশ্রয় নেওয়ার নজির এটিই প্রথম।
বছরজুড়ে নির্বাচন, রাজনৈতিক অস্থিরতা, অর্থনৈতিক সংকট, আন্দোলন-বিক্ষোভ, সরকার পতন, নতুন সরকার গঠনের মতো একের পর এক চড়াই উৎরাইয়ের সাক্ষী হয়েছে বাংলাদেশ। মুখোমুখি হয়েছে নতুন রাজনৈতিক বাস্তবতা ও সমীকরণের। আগের বছরের রাজনৈতিক অস্থিরতার ধারাবাহিকতায় ২০২৪ সাল শুরু হয়েছিল রাজনৈতিক টানাপোড়ন ও অনিশ্চয়তাকে সামনে রেখে। সেই টানাপোড়নের মধ্যেই ৭ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত হয় দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন। বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর অনুপস্থিতি এবং ভোটার উপস্থিতির হারের কারণে বিতর্কিত হয় দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন। বাংলাদেশের ইতিহাসে রেকর্ড গড়ে পঞ্চমবারের মতো প্রধানমন্ত্রী হন শেখ হাসিনা।
বিএনপিবিহীন ওই নির্বাচনে আওয়ামী লীগ দুই শতাধিক আসন পেলেও আগের সংসদের বিরোধী দল জাতীয় পার্টি মাত্র ১১টি আসন পায়। যেখানে স্বতন্ত্র প্রার্থীরা মিলে পেয়েছেন ৬২ আসন। ফলে সংসদে বিরোধী দল কে হবে, তা নিয়ে আলোচনা তৈরি হয়।
দুর্নীতি: ছাগল কাণ্ড এবং অন্যান্য
ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনালের ‘দুর্নীতির ধারণা সূচকে’ বাংলাদেশ বরাবরই নিচের দিকে অবস্থান করে। ২০২৪ সালের শুরুতে সংস্থাটি জানায়, আগের বছরে জরিপ অনুযায়ী দুর্নীতিগ্রস্ত হিসেবে দেশটির অবস্থান দশম। বছরটিতে সাবেক সেনাপ্রধান, সাবেক পুলিশ প্রধানের দুর্নীতি সংক্রান্ত খবর ব্যাপকভাবে আলোচিত হয়। আরো কয়েকটি দুর্নীতির খবরও আলোড়ন তোলে জনপরিসরে।
২০ মে সাবেক সেনাপ্রধান জেনারেল (অব.) আজিজ আহমেদ এবং তার পরিবারের সদস্যদের যুক্তরাষ্ট্রে প্রবেশের ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করে দেশটি। গণতন্ত্রের অবনতি ও দুর্নীতিতে জড়িত থাকার কারণ দেখিয়ে মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তর এই নিষেধাজ্ঞা দেয়। তবে নিষেধাজ্ঞার প্রতিক্রিয়ায় সাবেক এ সেনাপ্রধান দাবি করেন শাস্তি পাওয়ার মতো কোনো অপরাধ তিনি করেননি। আজিজ আহমেদের বিরুদ্ধে ঘুস গ্রহণের অভিযোগ আনে যুক্তরাষ্ট্র। বলা হয় ব্যক্তি স্বার্থের বিনিময়ে সরকারি নিয়োগের ব্যবস্থা করে দিয়েছেন তিনি। সাবেক পুলিশ প্রধান বেনজীর আহমেদের বিশাল বিত্ত-বৈভব নিয়ে গত ৩১ মার্চ প্রথম প্রতিবেদন প্রকাশ করে দেশের একটি সংবাদপত্র। এরপর বিভিন্ন গণমাধ্যমে তার সম্পদ নিয়ে খবর প্রকাশিত হয়।
ঢাকা মহানগর পুলিশের সাবেক কমিশনার আছাদুজ্জামান মিয়ার ‘অঢেল সম্পদ’ নিয়েও প্রতিবেদন প্রকাশ করে বিভিন্ন গণমাধ্যম। পুলিশ সদস্যদের নিয়ে প্রকাশিত প্রতিবেদনগুলোকে ‘উদ্দেশ্যমূলক ও অতিরঞ্জিত’ বলে অভিহিত করে এর প্রতিবাদ জানায় পুলিশ সার্ভিস অ্যাসোসিয়েশন।
ঈদুল আজহা অর্থাৎ কোরবানির ঈদের আগে একটি এগ্রো ফার্ম থেকে কোরবানি উপলক্ষে ‘১৫ লাখ টাকার’ একটি ছাগল কিনতে গিয়ে তুমুল আলোচনার জন্ম দেন মতিউর রহমান নামে এক রাজস্ব কর্মকর্তার ছেলে। ভাইরাল হওয়া খবরের সূত্র ধরে মতিউর রহমানের বিরুদ্ধে একের পর এক দুর্নীতির অভিযোগ সামনে আসতে থাকে। তার বিরুদ্ধে তদন্ত শুরু করে দুর্নীতি দমন কমিশন। সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এক সংবাদ সম্মেলনে জানান, তার পিয়ন দুর্নীতি করে ৪০০ কোটি টাকা অবৈধ সম্পদের মালিক হয়েছেন। এই তথ্য জনমনে ব্যাপক ক্ষোভ তৈরি করে।
৫ জুন: মুক্তিযোদ্ধা কোটা পুনর্বহাল
ছাত্র আন্দোলনের মুখে সরকারি নিয়োগের দুই শ্রেণিতে কোটা ব্যবস্থা বাতিল করে ২০১৮ সালে যে প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়েছিল, সেটি অবৈধ ঘোষণা করেন উচ্চ আদালত। এর ফলে প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণির সরকারি চাকরিতে মুক্তিযোদ্ধা কোটা ব্যবস্থা পুনর্বহাল হয়। ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া আসতে থাকে শিক্ষার্থীদের পক্ষ থেকে। যৌক্তিক সংস্কারের দাবিতে আন্দোলনের কথা বলেন তারা। বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসগুলোতে দাবির সপক্ষে প্রচার-প্রচারণা শুরু হয়।
ঘটনাবহুল জুলাই: আন্দোলনের মাস
কোটা সংস্কার আন্দোলনের একই সময়ে সর্বজনীন পেনশন ব্যবস্থা থেকে নিজেদের নাম কাটাতে আন্দোলনে নামেন বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকরা। জুন মাসে ধীরগতিতে আন্দোলনের যে প্রেক্ষাপট তৈরি হচ্ছিল জুলাইয়ের শুরুতে এসে সেটি গতি পায়। শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের পৃথক আন্দোলনে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলো উত্তপ্ত এবং একইসঙ্গে শিক্ষা কার্যক্রমের দিক থেকে স্থবির হয়ে পড়ে। টানা কর্মসূচি চালিয়ে যেতে থাকেন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতাকর্মীরা। ‘বাংলা ব্লকেড’ নামের কর্মসূচি ব্যাপক সাড়া ফেলে। এর মধ্যে ১০ তারিখে হাইকোর্টের দেওয়া রায়ে স্থিতাবস্থা দেয় আপিল বিভাগ। তবে পরবর্তী শুনানির সময় ধার্য করে চার সপ্তাহ পর।
ওইদিন দিবাগত রাতে চীন সফর থেকে ফেরেন শেখ হাসিনা। ১৪ জুলাই চীন সফর উপলক্ষে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে শেখ হাসিনা বলেন, কোটা নিয়ে আদালত থেকে সমাধান না আসলে সরকারের কিছু করার নেই। তিনি সেখানে প্রশ্ন করেন, ‘মুক্তিযোদ্ধাদের ওপর এত ক্ষোভ কেন? মুক্তিযোদ্ধাদের নাতি-পুতিরা চাকরি পাবে না, তাহলে কি রাজাকারের নাতিপুতিরা পাবে? তার এই বক্তব্যের জেরে তীব্র প্রতিক্রিয়া দেখা যায়। ওই রাত থেকেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ দেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে প্রতিবাদ বিক্ষোভ শুরু হয়। বিক্ষোভ মোকাবেলায় বলপ্রয়োগের পথে হাঁটে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ।
সহিংসতায় রক্তাক্ত বিশ্ববিদ্যালয়
১৫ জুলাই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পাশাপাশি রাজধানীর বাইরের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে কোটা সংস্কার আন্দোলনকারীদের ওপর ছাত্রলীগের হামলার খবর জানা যায়। দুই পক্ষের ধাওয়া পাল্টা ধাওয়া ও সংঘাতে আহত হয় অনেকে। ১৬ জুলাই প্রথম প্রাণহানির ঘটনা ঘটে। আন্দোলনে ছাত্রলীগ ও পুলিশের সাথে সহিংসতায় সারা দেশে ছয় জনের মৃত্যু হয়। এদের মধ্যে রংপুরে বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী আবু সাঈদের পুলিশের গুলির সামনে বুক পেতে দাঁড়ানো ও নিহত হওয়ার ভিডিও ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়ে। দেশজুড়েই বিক্ষোভের প্রতীক হয়ে ওঠেন রংপুরের এই শিক্ষার্থী। এদিন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ প্রায় সব ক্যাম্পাস থেকে ছাত্রলীগ বিতাড়িত হয়। ১৭ জুলাইও সংঘাত সহিংসতা অব্যাহত থাকে। দেশের সব ধরনের শিক্ষা প্রতিষ্ঠান অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ ঘোষণা করা হয়।
হত্যা ও হামলার প্রতিবাদে সারাদেশে ১৮ জুলাই কমপ্লিট শাটডাউন কর্মসূচি ঘোষণা করে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন। ১৮ জুলাই বৃহস্পতিবার রাত পর্যন্ত ২৫ জনের মৃত্যুর খবর নিশ্চিত করে গণমাধ্যম। আন্দোলনকারীদের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছিল মৃত্যুর সংখ্যা আরো বেশি হবে।
দেশের বিভিন্ন স্থানে মোবাইল ইন্টারনেটের সংযোগ পাওয়া যাচ্ছিল না। এক পর্যায়ে পুরোপুরি বন্ধ হয়ে যায় মোবাইল ইন্টারনেট। রাতের বেলা ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেটও বন্ধ হয়ে যায়।
১৯ জুলাই শুক্রবারও ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে ব্যাপক বিক্ষোভ ও সংঘর্ষ চলমান থাকে। জনপদগুলোতে থমথমে হয়ে ওঠে পরিস্থিতি। ঢাকায় মেট্রোরেল স্টেশন, এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের টোল প্লাজা, মিরপুর ইনডোর স্টেডিয়ামসহ বিভিন্ন সরকারি স্থাপনায় ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটে। নরসিংদীতে কারাগারে হামলা ও আগুনের পর আটশোর বেশি বন্দি পালানোর ঘটনা ঘটে। সারা দেশে সংঘর্ষে অন্তত ৫৬ জন নিহত হওয়ার তথ্য নিশ্চিতভাবে জানা যায়। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাওয়ায় রাত ১২টা থেকে জারি করা হয় কারফিউ।
জুলাইয়ের শেষ দশদিন
কারফিউর মধ্যেও ২০ জুলাই শনিবার ঢাকা, সাভার, গাজীপুর, ময়মনসিংহসহ বিভিন্ন স্থানে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সাথে বিক্ষোভকারীদের সংঘাতের ঘটনা ঘটে। বহু বিক্ষোভকারী হতাহত হন। ঢাকা ও নারায়ণগঞ্জে নিহত হন অন্তত ২৬ জন। এই কয়েক দিনে অন্তত ২০৮ জনের মৃত্যুর তথ্য নিশ্চিত করতে সমর্থ হয় গণমাধ্যম। এর মধ্যে কেবল ঢাকা মহানগরীর হাসপাতালগুলোতেই থেকেই অন্তত ১৬৫ জনের মৃত্যুর খবর আসে।
২২ জুলাই আপিল বিভাগের শুনানিতে কোটা পুনর্বহাল নিয়ে হাইকোর্টের রায় বাতিল হয়। মেধা ৯৩ শতাংশ, মুক্তিযোদ্ধা কোটা পাঁচ শতাংশ, ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী কোটা এক শতাংশ, প্রতিবন্ধী ও তৃতীয় লিঙ্গ কোটা এক শতাংশ নির্ধারণের আদেশ দেন আদালত। ২২ জুলাই, সোমবার কমপ্লিট শাটডাউন ৪৮ ঘণ্টার জন্য স্থগিতের ঘোষণা দেন কোটা আন্দোলনের অন্যতম সমন্বয়ক নাহিদ ইসলাম। ২৬ জুলাই বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের তিন সমন্বয়ক আসিফ মাহমুদ, নাহিদ ইসলাম ও আবু বাকের মজুমদারকে হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থা থেকে তুলে নিয়ে যাওয়ার অভিযোগ ওঠার পর রাতে গোয়েন্দা পুলিশের পক্ষ থেকে জানানো হয় নিরাপত্তাজনিত কারণে তাদের হেফাজতে নেওয়া হয়েছে। পরের কয়েকদিনে আরো কয়েকজন সমন্বয়ককে ডিবি অফিসে নেওয়া হয়।
আগস্টের বাংলাদেশ
১ অগাস্ট জামায়াত ইসলামী ও তাদের ছাত্র সংগঠন ইসলামী ছাত্রশিবিরের রাজনীতি নিষিদ্ধ করে প্রজ্ঞাপন জারি করে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। ২ আগস্ট শিক্ষক ও নাগরিক সমাজের দ্রোহযাত্রা কর্মসূচিতে যোগ দেন কয়েক হাজার মানুষ। ৩ আগস্ট বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ডাকে ঢাকার কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে ও চট্টগ্রামের নিউমার্কেট এলাকায় বিশাল সমাবেশ হয়, যেখানে অংশ নেন হাজার হাজার মানুষ। এছাড়া রংপুর, সিলেট, ফরিদপুর, রাজশাহী, বগুড়া, বরিশাল, নারায়ণগঞ্জ, বরগুনা, সিরাজগঞ্জ, কুমিল্লা, সিলেটসহ অনেক স্থানে মিছিল ও সমাবেশ হয়। ঢাকার সমাবেশ থেকে সরকারের পদত্যাগের দাবিতে ঘোষণা করা হয় এক দফা। শেখ হাসিনা আলোচনার আগ্রহ প্রকাশ করলেও সমন্বয়করা তা প্রত্যাখ্যান করেন। আন্দোলনকারীদের তরফে ৪ আগস্ট থেকে সর্বাত্মক অসহযোগ কর্মসূচি পালনের ডাক দেওয়া হয়। অসহযোগ কর্মসূচি ঘিরে উদ্ভূত পরিস্থিতি সামলাতে ৪ আগস্ট থেকেই তিনদিনের সাধারণ ছুটি ঘোষণা করে সরকার। এদিন সারাদেশে সহিংসতায় পুলিশসহ অন্তত ৮৩ জনের মৃত্যুর খবর পাওয়া যায়। আহত হন অনেক মানুষ। প্রথমে ৬ আগস্ট ঘোষণা করা হলেও পরে একদিন এগিয়ে ৫ আগস্ট সরকার পতনের দাবিতে লং মার্চ টু ঢাকার ডাক দেয় বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন।
৫ আগস্ট: শেখ হাসিনার পতন
৫ জুন কোটা ব্যবস্থা পুনর্বহালকে ঘিরে যে অসন্তোষ দানা বাঁধে ঠিক দুই মাসের মাথায় সেটিই সরকারের ভিত একেবারে নড়বড়ে করে দেয়। জুলাইয়ের তৃতীয় সপ্তাহে দেশ ছেড়ে পালানোর গুজব ছড়ানোর পর শেখ হাসিনা সদর্পে বলেছিলেন শেখ হাসিনা পালায় না। অথচ, দুই সপ্তাহের মাথায় ক্ষমতা ও দেশ ছেড়ে ভারতে আশ্রয় নেন তিনি।
৫ আগস্ট আন্তঃবাহিনী জনসংযোগ পরিদপ্তর-আইএসপিআর এক বিবৃতিতে জানায়, দেশের চলমান পরিস্থিতি নিয়ে বাংলাদেশ সময় দুপুর দুইটায় জাতির উদ্দেশে ভাষণ দেবেন সেনাপ্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান। এর মধ্যেই খবর আসে শেখ হাসিনা প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে পদত্যাগের পর বাংলাদেশ ছেড়ে গেছেন। সাথে ছিলেন তার বোন শেখ রেহানা। বিকাল চারটা নাগাদ সেনাসদর থেকে জাতির উদ্দেশে ভাষণ দেন সেনাপ্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান। তিনি বলেন, প্রধানমন্ত্রী পদত্যাগ করেছেন। এখন একটা অন্তর্বর্তী সরকার গঠন করবো এবং এই সরকারের মাধ্যমে এ দেশের সব কার্যকলাপ চলবে।
সরকারবিহীন তিন দিন
৫ তারিখ থেকে তিন দিন বাংলাদেশে কার্যত কোনো সরকার ছিল না। এতে নেতৃত্ব সংকটে প্রশাসনে এক ধরনের অচলাবস্থা তৈরি হয়, যার ফলে দেশটির আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতিতে ব্যাপক অবনতি দেখা দেয়।
অন্তর্বর্তী সরকার গঠন
তিনদিন পর নোবেলজয়ী অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসকে প্রধান উপদেষ্টা করে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠন করা হয়। প্রাথমিকভাবে উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য সংখ্যা ছিল ১৭ জন। পরে সেটি বেড়ে ২৪ জনে দাঁড়ায়। ভূমি মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা হাসান আরিফের মৃত্যুতে বর্তমানে উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য সংখ্যা ২৩ জন।
আমারবাঙলা/এমআরইউ