ফেনী প্রতিনিধি: শুরুতে হোয়াটসঅ্যাপ, ইমো কিংবা ম্যাসেঞ্জারে সুন্দরী মেয়েদের ছবি পাঠানো হয়। এরপর চলে প্রেমের অভিনয় ও কথোপকথন। একপর্যায়ে টার্গেটেড ব্যক্তিকে ডেকে নিয়ে আসা হয় ভাড়া বাসায়। তারপর চলে ছবি সেশন। পরিশেষে নগ্ন ছবি তুলে ব্লাকমেইল করা হয়।
ফেনী শহরে ‘ভালোবাসার ফাঁদ’ তৈরি করা এমন প্রতারক চক্রের সন্ধান পেয়েছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। অনেকে প্রতারণার শিকার হলেও লোকলজ্জার ভয়ে তা প্রকাশ করেন না।
এ ধরনের একটি মামলার অনুসন্ধান করতে গিয়ে প্রতারক চক্রের সহযোগিতাকারীদের মধ্যে পুলিশ সদস্যের নামও এসেছে। এ নিয়ে সংশ্লিষ্টদের মধ্যে সৃষ্টি হয়েছে চাঞ্চল্য।
সংশ্লিষ্ট একাধিক সূত্র জানায়, ফেনী শহরে সঙ্ঘবদ্ধ এ ধরনের একাধিক চক্র রয়েছে। চক্রের সদস্যরা বিভিন্ন ব্যক্তির মোবাইলে সুন্দরী নারীদের ছবি পাঠিয়ে টোপ দেয়। এরপর চলে কথাবার্তা ও প্রেমের অভিনয়। কথোপকথনের এক পর্যায়ে বাসায় আমন্ত্রণ জানানো হয়।
বাসায় চক্রের বাকি সদস্যরা অশ্লীল ছবি তুলে জিম্মি করে ফেলেন আমন্ত্রিত ব্যক্তিকে। শহরের নাজির রোড, পাগলা মিয়া সড়ক, পাঠানবাড়ী সড়ক ও পুরাতন পুলিশ কোয়ার্টার এলাকাসহ আরও কয়েকটি এলাকায় বাসা ভাড়া নিয়ে প্রতারক চক্র এ ধরনের ‘ভালোবাসার ফাঁদ’ পাতেন।
অবশ্য কিছুদিন পরপর চক্রের সদস্যরা বাসা পরিবর্তন করে। এ চক্রগুলোর সদস্যদের মধ্যে রয়েছে- ফেনী সদরের ফাজিলপুর-ছনুয়া এলাকার আবুল কাসেম জুয়েল, সুন্দরপুর এলাকার জেবু ওরফে রূপা, দাগনভূঞার ইয়াকুব পুর ইউনিয়নের দুধমুখা এলাকার বাসিন্দা শিমুল দাস, রাজু, জনি, আয়ু, বিবি রহিমা, দীপ্ত, জুয়েলের স্ত্রী রিমা আক্তার, সাথী, সাথীর ভাই রুবেল ও শিল্পী আক্তারের নাম উল্লেখযোগ্য।
তাদেরকে সহযোগিতাকারী কয়েকজন পুলিশ সদস্যের নামও ওঠে এসেছে। প্রতারক চক্রের তথ্যমতে, পুলিশ অভিযানে গেলেও বাসায় প্রবেশ করে না। বাইরে থেকেই দেন-দরবার করে টাকা হাতিয়ে নিয়ে সরে পড়ে।
সম্প্রতি দিদার হোসেন সুমন নামে এক ব্যবসায়ী এ সংক্রান্ত একটি মামলায় আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দী দেন। তিনি মডেল থানার বিপরীতে ব্লু সুপার কাট জেন্টস পার্লার ও বড় বাজারের আপন স্বর্ণ জুয়েলার্সের মালিক। তার বাড়ি শহরতলীর পাঁচগাছিয়া ইউনিয়নের মাথিয়ারা এলাকায়।
এই মামলার সাথে সংশ্লিষ্ট সূত্রটি জানান, পাঠানবাড়ী রোডের একটি ভবনের তৃতীয় তলার বাসায় এক ব্যক্তিকে ডেকে নেয় বিবি রহিমা। সেখানে দুইজনের নগ্ন ভিডিও ধারণ করে জুয়েল ও শিমুল।
তখন ওই ব্যক্তি কোনো উপায় না পেয়ে বিকাশ ও নগদ নাম্বার থেকে ৬০ হাজার টাকা দিয়ে ছাড়া পান। ওই টাকার ভাগ-বাটোয়ারার মধ্যে রহিমা ও জুয়েলকে ২০ হাজার টাকা দিয়ে বাকি টাকা পুলিশের পকেটে ঢুকে যায়।
জহিরিয়া মসজিদের পাশের একটি বাসায় চট্টগ্রাম থেকে এক ব্যক্তি আসেন। সেখানে জেমি নামে এক নারীর সাথে তার নগ্ন ভিডিও ধারণ করা হয়। একপর্যায়ে ওই ব্যক্তি ৫০ হাজার টাকা দিয়ে ছাড়া পান।
বিশ্বস্ত সূত্রে জানা গেছে, ওই টাকা থেকে এক পুলিশ কর্মকর্তা পেয়েছেন ২০ হাজার টাকা।
সূত্র আরও জানায়, আবুল কাশেম জুয়েল ওই চক্রের মূল হোতা। একাধিক নারীকে দিয়ে টার্গেটেড কোনো ব্যক্তিকে নিয়ন্ত্রণ করে সে। অ্যাকাডেমি রোডের অ্যাপোলো হাসপাতাল, স্টেডিয়াম সংলগ্ন এলাকা, পুরাতন রেজিস্ট্রি অফিস সংলগ্ন স্থানসহ জুয়েলের চারটি বাসা রয়েছে।
এ ধরনের আরেকটি চক্রের প্রধানের নাম রাজু ওরফে মনির। সে চট্টগ্রামের জোরারগঞ্জ থানার জসিম উদ্দিনের ছেলে। তার চক্রের অন্য সদস্যরা হলো- সাদিয়া, রাশি, মুন্নি, সালমা। তারা শহরের রামপুর এলাকা ও কুমিল্লা বাসস্ট্যান্ড-সংলগ্ন তারা নিবাসের গলিতে ফ্ল্যাট বাসা ভাড়া নিয়ে প্রতারণার ফাঁদ পাতে।
রুবেল নামে আরেকজন পুলিশ লাইন সংলগ্ন তার বোনের বাসা থেকে অন্য একটি চক্র নিয়ন্ত্রণ করে। শিপু ও রুনাসহ তার চক্রে রয়েছে আরও কয়েকজন মেয়ে সদস্য।
গত ১৯ ডিসেম্বর সালাহউদ্দিন মোড় সংলগ্ন উত্তরা আবাসিক এলাকায় রুনার বাসায় দাগনভূঞা উপজেলার মাতুভূঞা ইউনিয়নের ৬০ বছর বয়সী এক ব্যক্তিকে ছলনায় ডেকে এনে তার ভিডিও ধারণ করা হয়। পরিশেষে তার কাছ থেকে দুই লাখ টাকা দাবি করা হয়। ওই ব্যক্তি বাড়ি গিয়ে টাকা দেবে বলে চলে যায়।
ফেনী পৌরসভার ১৬ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর আমির হোসেন বাহার বলেন, পুরাতন পুলিশ কোয়ার্টার কিংবা রামপুর এলাকায় বাইরের লোকজন বাসা ভাড়া নিয়ে থাকে। তবে এ ধরনের অপকর্মের কোনো তথ্য পেলে আমরা দ্রুত ব্যবস্থা নিয়ে থাকি।
এ বিষয়ে পুলিশ সুপার জাকির হাসান বলেন, এ ধরনের একটি চক্র ইতোমধ্যে পুলিশের নজরে এসেছে। একজন গ্রেফতার হওয়ার পর তার কাছ থেকে বেশ কিছু তথ্য পাওয়া গেছে। সেসব তথ্য যাচাই-বাছাই করা হচ্ছে। পুলিশের কোনো সদস্য জড়িত কি না, সেটিও তদন্তাধীন রয়েছে।
এবি/এইচএন