ক্রীড়া প্রতিবেদক: বাছাই পর্ব খেলে আসা নেদারল্যান্ডসের কাছে বিশ্বকাপে বড় ব্যবধানে লজ্জাজনকভাবে পরাজিত হয়েছে বাংলাদেশ ক্রিকেট দল।
আজ বিশ্বকাপের ১৩ তম আসরে নিজেদের ষষ্ঠ ম্যাচে বাংলাদেশ ৮৭ রানে হেরেছে আইসিসি সহযোগী দেশ নেদারল্যান্ডসের কাছে। এই নিয়ে চতুর্থবার আইসিসির কোন সহযোগী দেশের কাছে হারলো বাংলাাদেশ। এর আগে ২০০৩ সালে কানাডা ও কেনিয়া এবং ২০০৭ সালে আয়ারল্যান্ডের কাছে হেরেছিলো টাইগাররা।
এই হারে ৬ ম্যাচে ১ জয় ও ৫ হারে ২ পয়েন্ট নিয়ে টেবিলের নবমস্থানে আছে বাংলাদেশ। ৬ ম্যাচে ৪ পয়েন্ট নিয়ে টেবিলের অষ্টমস্থানে উঠলো নেদারল্যান্ডস। বাংলাদেশের আগে দক্ষিণ আফ্রিকাকে হারিয়েছিলো নেদারল্যান্ডস।
অধিনায়ক স্কট এডওয়ার্ডসের হাফ-সেঞ্চুরিতে নিজেদের ষষ্ঠ ম্যাচে বাংলাদেশের বিপক্ষে প্রথমে ব্যাট করে ৫০ ওভারে সব উইকেট হারিয়ে ২২৯ রান করে নেদারল্যান্ডস। এডওয়ার্ডস ৮৯ বলে ৬৮ রান করেন। জবাবে চরম ব্যাটিং ব্যর্থতায় ৪২ দশমিক ২ ওভারে ১৪২ রানে অলআউট হয় বাংলাাদেশ।
কলকাতার ইডেন গার্ডেন্সে বাংলাদেশের বিপক্ষে টস জিতে প্রথমে ব্যাটিং বেছে নেয় নেদারল্যান্ডস। দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে আগের ম্যাচের একাদশ থেকে দু’টি পরিবর্তন নাসুম আহমেদ ও হাসান মাহমুদের পরিবর্তে তাসকিন আহমেদ ও মাহেদি হাসানকে নিয়ে মাঠে নামে টাইগাররা।
বল হাতে ইনিংসের দ্বিতীয় ওভারেই সাফল্য পান পেসার তাসকিন। মিড অফে অধিনায়ক সাকিব আল হাসানের হাতে ক্যাচ দিয়ে বিদায় নেন ৩ রান করা বিক্রমজিত সিং। পরের ওভারে সাফল্য পান বাঁ-হাতি পেসার শরিফুল ইসলামও। স্লিপে তানজিদ হাসানকে ক্যাচ দিয়ে খালি হাতে ফিরেন ম্যাক্স ও’দাউদ। ১৪ বলে ৪ রানে ২ উইকেট নিয়ে শুরুতেই নেদারল্যান্ডসকে চাপে ফেলে বাংলাদেশের পেসাররা। এবারের বিশ^কাপে এটিই দলের পেসারদের সেরা সাফল্য ।
শুরুর ধাক্কা সামলে উঠতে বাংলাদেশের বোলারদের সামনে প্রতিরোধ গড়ে তুলে ওয়েসলি বারেসি ও কলিন অ্যাকারম্যান হাফ-সেঞ্চুরির জুটি গড়েন। বলের সাথে পাল্লা দিয়ে রান তুলতে থাকা বারেসিকে ১৪তম ওভারে আউট করে বাংলাদেশকে ব্রেক-থ্রু এনে দেন মুস্তাফিজ। ৮টি চারে ৪১ বলে ৪১ রান করেন বারেসি। তৃতীয় উইকেটে অ্যাকারম্যান-বারেসি ৬৮ বলে ৫৯ রান যোগ করেন।
পরের ওভারে অ্যাকারম্যানকে ১৫ রানে শিকার করে বাংলাদেশকে খেলায় ফেরান সাকিব। ৬৩ রানে চতুর্থ উইকেট পতনে আবারও চাপে পড়ে নেদারল্যান্ডস। এ অবস্থায় ডাচদের আরও ভালোভাবে চেপে ধরার সুর্বন সুযোগ পেয়েছিলো বাংলাদেশ।
কিন্তু মুস্তাফিজের করা ১৬তম ওভারে দু’বার জীবন পান নেদারল্যান্ডস অধিনায়ক স্কট এডওয়ার্ডস। দ্বিতীয় বলে গালিতে লিটন দাস ও চতুর্থ বলে মুশফিকুর রহিম ক্যাচ ফেলেন। তখনও রানের খাতা খুলতে পারেননি এডওয়ার্ডস।
দু’বার জীবন পেয়ে পঞ্চম ও ষষ্ঠ উইকেটে দারুন জুটি গড়েন এডওয়ার্ডস। প্রথমে বাস ডি লিডেকে নিয়ে ৭৪ বলে ৪৪ ও পরে সিব্র্যান্ড এঙ্গেলব্রেখটের সাথে ১০৫ বলে ৭৮ রান যোগ করেন তিনি। লিডেকে ১৭ রানে থামান তাসকিন। এঙ্গেলব্রেখট ৩৫ রানে শিকার হন মাহেদির।
এঙ্গেলব্রেখটের সাথে জুটি গড়ার পথে ৪১তম ওভারে ওয়ানডেতে ১৫তম হাফ-সেঞ্চুরি করেন ৭৮ বল খেলা এডওয়ার্ডস। এই ইনিংসের মাধ্যমে নেদারল্যান্ডসের পক্ষে সর্বোচ্চ অর্ধশতকের মালিক এখন এডওয়ার্ডস।
হাফ-সেঞ্চুরির পর ইনিংস বড় করার চেষ্টা করেছিলেন এডওয়াডর্স। তবে ৪৫তম ওভারে মুস্তাফিজের বলে মিরাজকে ক্যাচ দিয়ে দলীয় ১৮৫ রানে আউট হন তিনি। তার আগে ৬টি চারে ৮৯ বলে ৬৮ রান করেন ডাচ অধিনায়ক।
এডওয়ার্ডস ফেরার পর ইনিংসের শেষদিকে লোগান ফন বিক ২টি চার ও ১টি ছক্কায় ১৬ বলে অপরাজিত ২৩, শারিজ আহমেদের ৬ ও আরিয়ান দত্তের ৯ রানে সম্মানজনক স্কোর পায় নেদারল্যান্ডস। ইনিংসে শেষ বলে শেষ উইকেট হারিয়ে ২২৯ রানের পুঁজি পায় নেদারল্যান্ডস।
বাংলাদেশের শরিফুল ৫১, তাসকিন ৪৩, মুস্তাফিজ ৩৬ ও মাহেদি ৪০ রানে ২টি করে উইকেট নেন। ৩৭ রানে ১ উইকেট নেন সাকিব।
২৩০ রানের টার্গেটে ভালো শুরুর ইঙ্গিত দিয়েছিলেন বাংলাদেশের দুই ওপেনার লিটন দাস ও তানজিদ হাসান। ৪ ওভারে ১৯ রান তুলে ফেলেন তারা। পঞ্চম ওভারের দ্বিতীয় বলে রিভার্স সুইপ করতে গিয়ে স্পিনার আরিয়ানের শিকার হন ১২ বলে ৩ রান করা লিটন। পরের ওভারে প্যাভিলিয়নের পথ ধরেন তানজিদও। পেসার বিককে পুল করতে গিয়ে উইকেটের পেছনে ক্যাচ দেন ৩টি চারে ১৫ রান করা তানজিদ।
১৯ রানে দুই ওপেনারকের হারিয়ে চাপে পড়ে বাংলাদেশ। বিশ^কাপে এই নিয়ে ছয় ম্যাচের মধ্যে পাঁচটিতেই বাংলাদেশের দুই ওপেনার ২০ রানের কোটা পার করতে ব্যর্থ হলেন।
দলকে চাপমুক্ত করতে তৃতীয় উইকেটে জুটি গড়ার চেষ্টা করেন তিন নম্বরে নামা মেহেদি হাসান মিরাজ ও চার নম্বরে নামা নাজমুল হোসেন শান্ত। দেখেশুনে খেলে রানের চাকা সচল রেখে ১১ ওভার শেষে দলীয় রান ৪০-এ নিয়ে যান তারা। তবে ১২তম ওভারে পেসার মিকেরেনের বলে স্লিপে বিককে ক্যাচ দেন ১৮ বলে ২টি চারে ৯ রান করা শান্ত। ভেঙ্গে যায় মিরাজের সাথে ৩৯ বলে ২৬ রানের জুটি।
দলীয় ৪৫ রানে শান্তর বিদায়ে উইকেটে আসেন অধিনায়ক সাকিব। ১৪ বল খেলে ৫ রান করে মিকেরেনের বলে খোঁচা মেরে উইকেটরক্ষক এডওয়ার্ডসকে ক্যাচ দিয়ে বিদায় নেন টাইগার দলপতি।
সাকিবের পর উইকেট পতনের খাতায় নাম তুলেন ক্রিজে সেট ব্যাটার মিরাজ। ১৭তম ওভারে লিডের বলে ড্রাইভ করতে গিয়ে উইকেটরক্ষকের হাতে বল জমা দেন তিনি। ৫টি চার ও ১টি ছক্কায় ৪০ বলে দলের পক্ষে সর্বোচ্চ ৩৫ রান করেন মিরাজ।
মিরাজ ফেরার পরের ওভারে মিকেরেনের বলে ইনসাইড এজড হয়ে বোল্ড হন ১ রান করা মুশফিকুর রহিম। ১৯ রানে প্রথম উইকেট পতনের পর ৭০ রানে ৬ উইকেট নেই বাংলাদেশের । ৭০ বা এরচেয়ে কম রানে ৬ উইকেট হারিয়ে বিশ^কাপে কখনও ম্যাচ জিততে পারেনি বাংলাদেশ।
এই কঠিন অবস্থায় মাহেদিকে নিয়ে উইকেট পতন ঠেকান মাহমুদুল্লাহ। উইকেট টিকে থাকতে সাবধানে খেলতে থাকেন তারা। দু’জনের জুটিতে ২৮তম ওভারে ১শ রান পায় বাংলাদেশ। ৩০তম ওভারে দলীয় ১০৮ রানে নিজেদের ভুলে মাহমুদুল্লাহ-মাহেদির জুটিটি ভাঙ্গে। ৩৮ বলে ১৭ রান করে রান আউট হন মাহেদি।
মাহেদি ফেরার ৫ রান পর লিডের বলে মিড উইকেটে আরিয়ানকে ক্যাচ দিয়ে প্যাভিলিয়নে ফিরেন বাংলাদেশের শেষ ভরসা মাহমুদুল্লাহ। আগের ম্যাচে সেঞ্চুরি করা মাহমুদুল্লাহ এবার ২টি চারে ৪১ বলে ২০ রান করেন।
মাহমুদুল্লাহর বিদায়ের পর দলের হারের ব্যবধান কমান তাসকিন ও মুস্তাফিজুর। নবম উইকেটে ২৯ রান তুলেন তারা। ফিজ ২০ ও তাসকিন ১১ রান আউট হলে ৪২ দশমিক ২ ওভারে ১৪২ রানেই গুটিয়ে যায় বাংলাদেশ। নেদারল্যান্ডসের মিকেরেন ২৩ রানে ৪ উইকেট নিয়ে হন ম্যাচের সেরা খেলোয়াড়।
আগামী ৩১ অক্টোবর কোলকাতার ইডেন গার্ডেন্সেই নিজেদের সপ্তম ম্যাচে পাকিস্তানের মুখোমুখি হবে বাংলাদেশ।
স্কোর কার্ড : (টস-নেদারল্যান্ডস)
নেদারল্যান্ডস ইনিংস :
বিক্রমজিত ক সাকিব ব তাসকিন ৩
ও’দাউদ ক তানজিদ ব শরিফুল ০
বারেসি ক সাকিব ব মুস্তাফিজ ৪১
অ্যাকারম্যান ক মুস্তাফিজ ব সাকিব ১৫
এডওয়ার্ডস ক মিরাজ ব মুস্তাফিজ ৬৮
লিডে ক মুশফিক ব তাসকিন ১৭
এঙ্গেলব্রেখট এলবিডব্লু ব মাহেদি ৩৫
বিকে অপরাজিত ২৩
শারিজ রান আউট ৬
আরিয়ান ক মিরাজ ব শরিফুল ৯
মিকেরেন এলবিডব্লু ব মাহেদি ০
অতিরিক্ত (বা-৪, লে বা-১, ও-৭) ১২
মোট (অলআউট, ৫০ ওভার) ২২৯
উইকেট পতন : ১/৩ (বিক্রমজিত), ২/৪ (ও’দাউদ), ৩/৬৩ (বারেসি), ৪/৬৩ (অ্যাকারম্যান), ৫/১০৭ (লিডে), ৬/১৮৫ (এডওয়ার্ডস), ৭/১৮৫ (এঙ্গেলব্রেখট), ৮/১৯৪ (শারিজ), ৯/২১২ (আরিয়ান), ১০/২২৯ (মিকেরেন)।
বাংলাদেশ বোলিং :
শরিফুল : ১০-০-৫১-২ (ও-৩),
তাসকিন : ৯-১-৪৩-২ (ও-১),
সাকিব : ১০-১-৩৭-১,
মিরাজ : ৪-০-১৭-০,
মুস্তাফিজুর : ১০-১-৩৬-২ (ও-১),
মাহেদি : ৭-০-৪০-২ (ও-১)।
বাংলাদেশ ইনিংস :
লিটন ক এডওয়ার্ডস ব দত্ত ৩
তানজিদ ক এডওয়ার্ডস ব বিকে ১৫
মিরাজ ক এডওয়ার্ডস ব লিডে ৩৫
শান্ত ক বিকে ব মিকেরেন ৯
সাকিব ক এডওয়ার্ডস ব মিকেরেন ৫
মুশফিক ব মিকেরেন ১
মাহমুদুল্লাহ ক আরিয়ান ব লিডে ২০
মাহেদি রান আউট ১৭
তাসকিন ক লিডে ব মিকেরেন ১১
মুস্তাফিজুর বোল্ড ব অ্যাকারম্যান ২০
শরিফুল অপরাজিত ০
অতিরিক্ত (ও-৬) ৬
মোট (অলআউট, ৪২.২ ওভার) ১৪৩
উইকেট পতন : ১/১৯ (লিটন), ২/১৯ (তানজিদ), ৩/৪৫ (শান্ত), ৪/৬৩ (সাকিব), ৫/৬৯ (মিরাজ), ৬/৭০ (মুশফিক), ৭/১০৮ (মাাহেদি), ৮/১১৩ (মাহমুদুল্লাহ), ৯/১৪২ (মুস্তাফিজুর), ১০/১৪২ (তাসকিন)।
নেদারল্যান্ডস বোলিং :
আরিয়ান : ১০-৩-২৬-১,
বিক : ৯-১-৩০-১ (ও-৪),
অ্যাকারম্যান : ৭-১-২৫-১,
মিকেরেন : ৭.২-০-২৩-৪ (ও-২),
লিডে : ৭-০-২৫-২,
শারিজ : ২-০-১৩-০।
ফল : নেদারল্যান্ডস ৮৭ রানে জয়ী।
এবি/এইচএন