চট্টগ্রামের কর্ণফুলী উপজেলার বড়উঠান ইউনিয়নের দেয়াঙ পাহাড়ের নিরিবিলি পরিবেশে আছে মরিয়ম আশ্রম। পর্তুগিজ বণিকদের হাতে পত্তন হওয়া প্রায় ৫০০ বছরের পুরোনো খ্রিষ্টান পল্লিকে ঘিরে গড়ে উঠেছে এই আশ্রম।
আশ্রমের চারদিকে পাহাড়ঘেরা সবুজ মাঠ। সুনসান পরিবেশ। হরেক রকম ফুল ও পাতাবাহার গাছে পাখিদের কলকাকলি। মাঠের একপাশে পাহাড়ের গায়ে সিঁড়ির ধাপ। সিঁড়ি বেয়ে উঠলে দেখা যায় কাচেঘেরা যিশুমাতা মরিয়মের প্রতিকৃতি। আশপাশে বেশ কিছু দৃষ্টিনন্দন আশ্রম ও ধ্যানঘর।
চট্টগ্রাম শহর থেকে দেয়াঙ পাহাড়ে যেতে পার হতে হবে শাহ আমানত সেতু। সেখান থেকে কোরীয় রপ্তানি প্রক্রিয়াজাতকরণ অঞ্চলের (কেইপিজেড) গেটে গিয়ে নামতে হবে। গেটে থেকে কেইপিজেড সড়ক ধরে এক কিলোমিটার গেলেই দেয়াঙ পাহাড়ের মরিয়ম আশ্রম।
আশ্রমের প্রবেশপথে মূল ফটকের পাশে ক্রুশসম্বলিত একটি পাথরের ফলকে বড় করে লেখা আছে—‘দিয়াঙে খ্রিস্টবাণী প্রচারের গোড়াপত্তন।’ সেখান থেকেই জানা গেল, ১৫১৮ সালে চট্টগ্রামে আসেন পর্তুগিজ বণিকেরা। ১৫৩৭ সালের দিকে তারা দেয়াঙ পাহাড় এলাকায় বসতি স্থাপন করেন। দক্ষিণ ভারতের কোচিন থেকে খ্রিষ্টধর্ম প্রচারের জন্য ১৫৯৮ সাল থেকে চট্টগ্রামে মিশনারি ও যাজকেরা আসতে থাকেন। যাদের মধ্যে প্রথম আসেন জেসুইট ধর্মসংঘের পুরোহিত ফাদার ফ্রান্সেসকো ফার্নান্দেজ। ১৫৯৯ সালে দেয়াঙে চট্টগ্রামের প্রথম গির্জা নির্মাণ করেন তিনি। ১৬০০ সালে তিনি চট্টগ্রাম শহরের বান্ডেল রোড ও জামালখান এলাকায় আরো দুটি গির্জা নির্মাণ করেন।
মরিয়ম আশ্রমের প্রতিষ্ঠাতা ব্রাদার ফ্লেভিয়ান লাপ্লান্তের স্মৃতিস্তম্ভও দেখা গেল পাহাড়ের উপর। আশ্রম ঘুরে দেখার সময় একটি প্রার্থনাঘর থেকে বেরিয়ে আসেন আশ্রমের সুবর্ণজয়ন্তীর প্রচার ও প্রকাশনা কমিটির সমন্বয়কারী ব্রাদার সিলভেস্টার মৃধা। তিনি বলেন, দেয়াঙের ৫০০ বছরের ইতিহাসকে দুই ভাগে ভাগ করা হয়। একটি হচ্ছে গোড়াপত্তনের, আরেকটি শেষের দিকের ১০০ বছরের ইতিহাস। মরিয়ম আশ্রমের পাশে জোশেফ পাড়া ও মরিয়ম পাড়ায় প্রায় হাজারখানেক মানুষ বংশ পরম্পরায় বসবাস করে আসছেন। ১৬২৯ থেকে ১৬৩১ সাল পর্যন্ত পর্তুগিজ বংশোদ্ভূত আগস্টিনিয়ান যাজকেরা দেয়াঙে ছিলেন। এখনো ওই পর্তুগিজ বংশের ১২টি পরিবার এবং ডি রোজা বংশের ১১টি পরিবার দেয়াঙ পাহাড়ে আছে।
ব্রাদার সিলভেস্টার মৃধা আরো বলেন, ১৯৩২ সালের ১৭ অক্টোবর কানাডা থেকে চট্টগ্রামে আসেন ব্রাদার ফ্লেভিয়ান লাপ্লান্ত। তিনি দেয়াঙে এসে এখানকার বিভিন্ন সম্প্রদায়ের আর্থসামাজিক উন্নয়নের পাশাপাশি নানা সেবামূলক কাজের উদ্যোগ নেন। তিনিই এই আশ্রম গড়ে তোলেন। আজকের মরিয়ম আশ্রম মা মারিয়ার পুণ্য তীর্থস্থান হিসেবে খ্রিষ্টান তীর্থযাত্রীদের কাছে সমাদৃত। আগের ইতিহাস ভালো না হলেও বর্তমানে দেয়াঙ এলাকা সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বিরাজ করছে।
১৯৪৬ সালে ব্রাদার ফ্লেভিয়ান লাপ্লান্ত গড়ে তোলেন মরিয়ম আশ্রম উচ্চবিদ্যালয়। এখানে এখন দেড় হাজারের বেশি শিক্ষার্থী পড়াশোনা করছে। আশ্রমের পাশে গড়ে তোলা হয়েছে ধ্যান-প্রার্থনার জায়গা, গির্জা, চিকিৎসাসেবা কেন্দ্র, ছাত্রাবাস। এ ছাড়া তিনতলাবিশিষ্ট ধ্যানকেন্দ্র গড়ে তোলা হচ্ছে, যাতে নির্জনে বসে ধ্যানসাধনা করা যাবে। প্রতিবছর ফেব্রুয়ারি মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহে আয়োজন হয় দুই দিনব্যাপী মা মরিয়মের তীর্থ উৎসব। তীর্থ দর্শনে আসেন সারা দেশের মানুষ।
১৯৭৬ সালের ২৬ ডিসেম্বর দেয়াঙ পাহাড়কে তীর্থস্থান হিসেবে ঘোষণা দেন তৎকালীন বিশপ জোয়াকিম রোজারিও। ২০২৪ সালে মা-মারিয়ার উৎসব উপলক্ষে প্রকাশিত প্রকাশনা গ্রন্থ থেকে জানা গেছে, এই এলাকার খ্রিষ্টানদের ওপর আরাকানি সৈন্যদের অত্যাচারের প্রতিবাদ করতে গিয়ে মৃত্যুবরণ করেন ফাদার ফ্রান্সেসকো ফার্নান্দেজ। ওই বছরই আরাকান রাজার নির্দেশে দেয়াঙে অবস্থানরত ৬০০ পর্তুগিজ শিশু, নারী ও পুরুষকে হত্যা করা হয়। ফাদার ফার্নান্দেজের সমাধির উপরই বর্তমানে চট্টগ্রামের ক্যাথিড্রাল গির্জা দাঁড়িয়ে আছে।
মরিয়ম আশ্রম উচ্চবিদ্যালয়ের শিক্ষক দেবাশীষ দত্ত বলেন, আশ্রমে প্রতিদিন শত শত লোক আসেন। তারা শুধু বেড়াতেই আসেন না, পাঠ নেন ইতিহাসেরও। ১৯৮১ সালের ১৯ জুন আশ্রমের প্রতিষ্ঠাতা ফ্লেভিয়ান লাপ্লান্তের মৃত্যুর পর ২০০০ সাল থেকে আশ্রমের দায়িত্ব পালন করে আসছেন ব্রাদার লরেন্স ডায়েস। ৯৫ বছর বয়সী ডায়েসকে আশ্রমের চতুর্থ আশ্রম গুরু হিসেবে ঘোষণা দেওয়া হয়।
আমারবাঙলা/এমআরইউ