বাংলাদেশ-ভারতের মধ্যে সম্পর্কের টানাপোড়নের মাঝে ভারত বাংলাদেশ, নেপাল ও ভুটানকে দেওয়া ট্রান্সশিপমেন্ট সুবিধা বাতিল করেছে। এতে বাংলাদেশ, নেপাল ও ভুটানের মধ্যে চলমান বাণিজ্য ক্ষতিগ্রস্ত হবে বলে ধারণা করা হলেও সরকার বলছে বড় ধরনের সমস্যা হবে না। এমনকি ব্যবসায়ীরা বলছেন, ক্ষণিকের সমস্যা কাটিয়ে ওঠা সম্ভব। এর জন্য বিমানবন্দরের সক্ষমতা বাড়ানো ও কার্গো ভাড়া প্রতিযোগিতামূলক করার দাবি তাদের।
বৃহস্পতিবার (১০ এপ্রিল) সচিবালয়ে সাংবাদিকদের প্রশ্নের উত্তরে বাণিজ্য উপদেষ্টা সেখ বশিরউদ্দীন আহমেদ বলেন, বড় ধনের সমস্যা হবে না; আমরা কাটিয়ে উঠব।
এদিকে বৃহস্পতিবারই যশোরের বেনাপোল দিয়ে নেপালে যাওয়ার পথে গার্মেন্টস পণ্যবাহী চারটি ট্রাক ফেরত এসেছে। অন্যদিকে দেশের চারদেশীয় স্থলবন্দর বাংলাবান্ধা দিয়ে এদিন সকাল থেকেই ভারত, নেপাল ও ভুটানের মধ্যে আমদানি-রপ্তানি কার্যক্রম স্বাভাবিক ছিল।
ভারতের সেন্ট্রাল বোর্ড অব ইনডিরেক্ট ট্যাক্সেস অ্যান্ড কাস্টমস (সিবিআইসি) মঙ্গলবার এক সার্কুলারে দেশটির বন্দর বা বিমানবন্দর ব্যবহার করে বাংলাদেশ থেকে তৃতীয় কোনো দেশে রপ্তানি পণ্যের ট্রান্সশিপমেন্ট সুবিধা বাতিল করার কথা জানায়।
বিষয়টি নিয়ে আলোচনা শুরু হলে বুধবার ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এক ব্যাখ্যায় বলে, বাংলাদেশের পণ্যের ট্রান্সশিপমেন্ট সুবিধা বাতিল করার যে সিদ্ধান্ত হয়েছে, তা নেপাল বা ভুটানগামী পণ্য চালানের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হবে না।
ট্রান্সশিপমেন্টের মাধ্যমে ভারতের ভূখণ্ড ব্যবহার করে বাংলাদেশের পণ্য তৃতীয় দেশে নিয়ে যাওয়ার সুবিধা দিতে ২০২০ সালের ২৯ জুন আদেশ জারি করেছিল ভারত।
বড় কোনো সমস্যা হবে না-বাণিজ্য উপদেষ্টা: ভারতে ট্রান্সশিপমেন্ট সুবিধা বাতিল করায় বাংলাদেশ বড় ধরনের কোনো সমস্যায় পড়বে বলে মনে করছেন না বাণিজ্য উপদেষ্টা সেখ বশিরউদ্দীন আহমেদ।
বৃহস্পতিবার সচিবালয়ে সাংবাদিকদের প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, খবর পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে সব অংশীজন, বিমান, সিভিল এভিয়েশন, প্রাইভেট সেক্টর- সবার সঙ্গে বৈঠক করেছি। কোনো সমস্যা বোধ করছি না।
সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে বণিজ্য উপদেষ্টা বলেন, নিজস্ব উদ্যোগে আমাদের প্রতিযোগিতা সক্ষমতায় যেন কোনো ঘাটতি না পড়ে, রপ্তানির ক্ষেত্রে যোগাযোগে যেন কোনো ঘাটতি না পড়ে সেজন্য সব ব্যবস্থা আমরা নিচ্ছি। কী কী ব্যবস্থা নিচ্ছি তা হয়তো এই মুহূর্তে শেয়ার করব না। আমাদের কাঠামোগত ও খরচের দিক থেকে যে প্রতিবন্ধকতা রয়েছে সেটি সমন্বয়ের মাধ্যমে সক্ষমতা বাড়াব। আমি কোনো সমস্যা দেখছি না।
পাল্টা কোনো পদক্ষেপ বাংলাদেশ নেবে কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, সেটি আমার বিষয় না। আমার কাজ হচ্ছে বাণিজ্যিক সক্ষমতা বাড়ানো।
যে সুবিধা ভারত বন্ধ করেছে তার মাধ্যমে ৪০ থেকে ৫০ হাজার টন মালামাল সড়ক পথে ভারতের বিভিন্ন বন্দরে যেত। এসব পণ্য চালানের গন্তব্য ইউরোপের বিভিন্ন দেশ। উপদেষ্টা বলেন, এটি আমরা নিজেরাই ক্যারি করার সক্ষমতা বাড়াব।
যা বলছেন ব্যবসায়ী ও অর্থনীতিবিদরা: বাংলাদেশের রপ্তানি পণ্যের ট্রান্সশিপমেন্ট সুবিধা বাতিলে বড় ধরনের সংকট দেখছেন না ব্যবসায়ীরা। তারা রাজধানীর শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের সক্ষমতা বাড়ানো ও কার্গো ভাড়া প্রতিযোগিতামূলক করার দাবি জানিয়েছেন।
এদিকে অর্থনীতিবিদরা বলছেন, নেপাল-ভুটানে পণ্য রপ্তানিতে ট্রানজিট সুবিধা বহাল রেখেছে ভারত। তবে, ভারতের ট্রান্সশিপমেন্ট সুবিধা বাতিল হওয়ায় তৃতীয় কোনো দেশে রপ্তানিতে খরচ বাড়বে।
আন্তর্জাতিক ক্রেতাদের চাহিদাপূরণে সময়মতো পণ্য পাঠাতে কখনো কখনো আকাশপথও ব্যবহার করতে হয়। বাংলাদেশের বিমানবন্দরের সক্ষমতা কম থাকায় করোনাকালে ২০২০ সালে ট্রান্সশিপমেন্ট সুবিধা দেয় ভারত। যার আওতায়, তৃতীয় কোনো দেশে রপ্তানিতে ভারতের সমুদ্র ও বিমানবন্দর ব্যবহার করতে পারতো দেশের ব্যবসায়ীরা।
এই সুবিধা সবচেয়ে বেশি ব্যবহার করে পোশাক রপ্তানিকারকরা। তারা বলছেন, বছরে আকাশ পথে আনুমানিক যে ১২০ কোটি ডলারের পণ্য রপ্তানি হয়, তার আট থেকে ১০ ভাগ যেত ভারত হয়ে। সেক্ষেত্রে কার্গো ভাড়া বাঁচতো ২০ থেকে ২৫ ভাগ।
ঢাকা চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিজের সাবেক সভাপতি শামস মাহমুদ বলেন, ‘আমরা দেখতাম যে ওখানে সব সময় ২০-৩০ ভাগ সস্তা থাকত। আমাদের বিমানবন্দরে একটা ব্যাকলগ হতো, ওটার জন্যই আমরা কলকাতায় যেতাম। আমরা আশা করব, থার্ড টার্মিনাল হচ্ছে, এখানে যেন বাংলাদেশের এক্সপ্যানশন অব বিজনেস..। আমরা এখন ৩৯ বিলিয়ন এক্সপোর্ট করছি, ১০০ বিলিয়ন আমরা সামনে বলছি যে করব। এটিকে আমলে নিয়ে এই অবকাঠামো যেন আমাদের বিমানবন্দরেই থাকে এবং কোনো ট্রান্সশিপমেন্টের যাতে প্রয়োজন না হয়।’
তৈরি পোশাক রপ্তানিকারকদের শীর্ষ সংগঠন বিজিএমইএ’র প্রশাসক আনোয়ার হোসেন বলেন, ‘আমাদের যে এয়ার কার্গো ফ্যাসিলিটি, এটাকে যদি আমরা কস্ট কমপিটিটিভ করতে পারি, দক্ষতা বাড়াতে পারি, সিভিল এভিয়েশন-বিমান-সরকার, সবাই যদি সমন্বয় করতে পারি ইভেন ব্র্যান্ডগুলোও আমাদের সাথে সমন্বয় করতে আগ্রহী।’
বাংলাদেশের ট্রান্সশিপমেন্ট বাতিলের পেছনে যুক্তি হিসেবে, বিমানবন্দরে স্থানীয় রপ্তানিকারকদের পণ্যজট দেখাচ্ছে ভারত। তবে, ভূ-রাজনৈতিক টানাপোড়নকেও উড়িয়ে দিচ্ছেন না অর্থনীতিবিদরা।
অর্থনীতিবিদ মাহফুজ কবির বলেন, ‘নেপাল, ভুটান, মিয়ানমার থেকে শুরু করে অন্য কোনো তৃতীয় দেশ, প্রত্যেক জায়গাতেই আমাদের নিজস্ব ক্যাপাসিটিতে পুরো ব্যবস্থাটা করে নিতে হবে। যাতে করে আমরা এই দেশগুলোতে এক্সপোর্ট করতে পারি। ভারত থেকে হলে ভালো হত যে খরচটা কমত, সময়টাও কম লাগত। আমাদের ভারতের সাথে আলাপ আলোচনা চালিয়ে যেতে হবে।’
ভারতে ঢোকার অনুমতি পায়নি চার ট্রাক তৈরি পোশাক, গন্তব্য ছিল স্পেন: ভারত সরকার ট্রান্সশিপমেন্টের সুবিধা প্রত্যাহার করায় পেট্রাপোল কাস্টমস তৈরি পোশাকবোঝাই চারটি ট্রাককে দেশটিতে প্রবেশের অনুমতি (কারপাস) দেয়নি। এতে যশোরের বেনাপোল স্থলবন্দর থেকে বুধবার ট্রাকগুলো ঢাকায় ফিরিয়ে দেওয়া হয়েছে।
বেনাপোল স্থলবন্দর সূত্র জানায়, মঙ্গলবার ঢাকা থেকে তৈরি পোশাক রপ্তানিকারক তিনটি প্রতিষ্ঠান চারটি ট্রাকে পণ্য বোঝাই করে বেনাপোল বন্দরে নিয়ে আসে। ট্রানজিট নিয়ে ওই পণ্য কলকাতার দমদম বিমানবন্দর হয়ে স্পেনে রপ্তানি হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু ভারতের পেট্রাপোল কাস্টমস থেকে ট্রাকগুলো প্রবেশের অনুমতি পায়নি। এতে পণ্যগুলো সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান ফিরিয়ে নিয়েছে।
বেনাপোলে এই পণ্যের ক্লিয়ারিং অ্যান্ড ফরোয়াডিং (সিঅ্যান্ডএফ) এজেন্ট ছিল পদ্মা ট্রেডিং। এ বিষয়ে জানতে চাইলে প্রতিষ্ঠানটির মালিক অনিক আহমেদ বলেন, ‘পূর্ব ঘোষণা ছাড়াই হঠাৎ ভারত সরকার ট্রান্সশিপমেন্টের সুবিধা প্রত্যাহার করেছে। এর আগেই ট্রাকবোঝাই এসব পণ্য বেনাপোল বন্দরে চলে আসে। পণ্য ঢুকতে না দেওয়ায় রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠান ও আমরা ব্যাপক ক্ষতির মুখে পড়েছি।’ তিনি জানান, এই সুবিধা বাতিলের এক দিন আগেও ২০ ট্রাক তৈরি পোশাক তাদের প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে ভারতের ট্রানজিট ব্যবহার করে ইউরোপের বিভিন্ন দেশে পাঠানো হয়েছে। সাধারণত তৈরি পোশাকের রপ্তানি গ্রীষ্মে বাড়ে। এখন রপ্তানির ভরা মৌসুম। এই মুহূর্তে ভারতের এই সিদ্ধান্তে তাঁরা বিরাট ক্ষতির মুখে পড়েছেন।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে বেনাপোল স্থলবন্দরের পরিচালক শামীম হোসেন বলেন, ‘যে রপ্তানিকারকের পণ্য ফিরে গেছে, তাদের কোনো প্রতিনিধি আমাদের কিছু জানাননি। তবে আমরা জেনেছি, ভারতের পেট্রাপোল কাস্টমস থেকে কারপাস দেওয়া হয়নি। যে কারণে পণ্য ফিরিয়ে নেওয়া হয়েছে।’
ট্রান্সশিপমেন্টের সুবিধা দেওয়ার পর বাংলাদেশ থেকে তৃতীয় কোনো দেশে পণ্য রপ্তানিতে ভারতের কলকাতা বন্দর, নবসেবা বন্দর ও কলকাতা বিমান কার্গো কমপ্লেক্স ব্যবহার করার সুযোগ দিয়েছিল সিবিআইসি।
বেনাপোল বন্দর ব্যবহারকারীরা জানান, বেনাপোল দিয়ে ভারতের ট্রানজিট নিয়ে তৃতীয় কোনো দেশে যেসব পণ্য রপ্তানি করা হয়, তার বেশির ভাগ যায় ইউরোপের দেশগুলোয়। বাংলাদেশের তৈরি পোশাক বেনাপোল ও পেট্রাপোল দিয়ে স্পেন ও সুইজারল্যান্ডে বেশি যায়। এই বন্দর দিয়ে নেপাল ও ভুটানে পণ্য রপ্তানি কম হয়।
বাংলাবান্ধা স্থলবন্দরে আমদানি-রপ্তানি স্বাভাবিক, নেপালে গেল আলু: ভারত সরকারের ট্রান্সশিপমেন্ট সুবিধা প্রত্যাহারের কোনো প্রভাব পড়েনি দেশের চারদেশীয় স্থলবন্দর বাংলাবান্ধায়। বৃহস্পতিবার সকাল থেকেই বন্দরটি দিয়ে ভারত, নেপাল ও ভুটানের মধ্যে আমদানি-রপ্তানি কার্যক্রম স্বাভাবিক ছিল বলে জানিয়েছেন বাংলাবন্ধা স্থলবন্দর ম্যানেজার আবুল কালাম আজাদ।
নেপালে নিয়মিত আলু রপ্তানির ধারাবাহিকতায় বৃহস্পতিবার আরো ১৪৭ মেট্রিক টন আলু রপ্তানি হয়েছে নেপালে।
বাংলাবান্ধা স্থলবন্দরের উদ্ভিদ সংগনিরোধ কেন্দ্রের কোয়ারেন্টিন ইন্সপেক্টর উজ্জ্বল হোসেন বলেন, বাংলাবান্ধা স্থলবন্দরের আমদানি-রপ্তানি কার্যক্রম স্বাভাবিক রয়েছে। বৃহস্পতিবার ১৪৭ মেট্রিক টন আলু নেপালে গেছে। এখন পর্যন্ত মোট ৩৪০২ মেট্রিক টন আলু নেপালে রপ্তানি করা হলো।
বাংলাবান্ধা স্থলবন্দর কর্তৃপক্ষ জানায়, ট্রান্সশিপমেন্ট সুবিধা বন্ধের জন্য ভারতের অর্থ মন্ত্রণালয় একটি চিঠি ইস্যু করেছে কাস্টমসে। তবে বাংলাবান্ধা স্থলবন্দরে আমদানি-রপ্তানি কার্যক্রম স্বাভাবিক রয়েছে। বৃহস্পতিবার বিকাল পর্যন্ত বন্দরটি দিয়ে ভুটান থেকে ২৯ ট্রাক পাথর, নেপাল থেকে আখের চিটাগুড় ১১ ট্রাক, ভারত থেকে পাচ ট্রাক আতপ চাল, নেপাল থেকে তিন ট্রাক কাচ, ভারত থেকে এক ট্রাক পাথর এসেছে। অপরদিকে নেপালে রো-জুট আট ট্রাক, ফ্রেস পটোটো সাত ট্রাকে ১৭১ মেট্রিক টন, টিস্যু পেপার ছয় ট্রাক, কটন র্যাগস দুই ট্রাকসহ পণ্য রপ্তানিকৃত পণ্যবাহী ট্রাক ছেড়ে গেছে।
বন্দরটি দিয়ে বাংলাদেশ থেকে ভারত ও নেপালে পাট, ওষুধ, প্রাণ ও ওয়ালটনের পণ্য, জুস, মোটরসাইকেল, ব্যাটারিসহ নানা ধরনের পণ্য রপ্তানি হচ্ছে। অপরদিকে মসুর ডাল, গম, ভুট্টা, চিরতা, হাজমলা, যন্ত্রপাতি, প্লাস্টিক দানা, রেললাইনের স্লিপার, খৈল, আদা ও চিটাগুড় আমদানি করা হয়।
বাংলাবন্ধা স্থলবন্দরের ম্যানেজার আবুল কালাম আজাদ বলেন, ভারত সরকার ট্রান্সশিপমেন্ট সুবিধা প্রত্যাহার করলেও স্বাভাবিক রয়েছে আমাদের স্থলবন্দর। আগের দিনের মতোই বৃহস্পতিবার আমদানি-রপ্তানি কার্যক্রম চালু রয়েছে। এদিন সকাল থেকে বন্দর সংশ্লিষ্ট দেশগুলোতে আমদানি পণ্য প্রবেশ করছে ও রপ্তানি হওয়া পণ্য বাংলাদেশ থেকে যাচ্ছে। বিকাল ৪টা পর্যন্ত বন্দরটিতে ৪৯ ট্রাক পণ্য আমদানি, ২৪ ট্রাক রপ্তানি পণ্যবাহী ট্রাক আসা-যাওয়া করেছে।
আমারবাঙলা/এমআরইউ