বিপ্লব হচ্ছে রাজনৈতিক ক্ষমতা বা প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামোতে মৌলিক সামাজিক পরিবর্তন যা সাধারণত অল্প সময়ের মধ্যে ঘটে যখন জনগণ চলমান কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে জেগে উঠে।
কিন্তু শিল্প বিপ্লব (ইংরেজি: Industrial Revolution) এসেছিল নতুন নতুন যন্ত্রপাতি, কল-কারখানা তৈরি করে অর্থনীতিতে গতি সঞ্চার করার মধ্য দিয়ে। এটি কৃষি বিপ্লবের পর গ্রেট ব্রিটেন, ইউরোপ মহাদেশ এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে প্রায় ১৭৬০ থেকে ১৮৪০ সালের মধ্যে ঘটেছিল। এই বিপ্লবের মাধ্যমে উৎপাদন পদ্ধতিতে হাতের পরিবর্তে মেশিনের ব্যবহার করা হয়েছিল।
১৮৭০ সালের পর থেকে দ্রুত অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ঘটতে শুরু করে, যাকে দ্বিতীয় শিল্প বিপ্লব বলা হয়। সে সময়কার উদ্ভাবনের মধ্যে নতুন ইস্পাত তৈরির প্রক্রিয়া, গণ-উৎপাদন, অ্যাসেম্বলি লাইন, বৈদ্যুতিক গ্রিড সিস্টেম, বড় আকারের মেশিন টুলস এবং বাষ্পচালিত কারখানায় ক্রমবর্ধমান উন্নত যন্ত্রপাতির ব্যবহার অন্তর্ভুক্ত ছিল।
ডিজিটাল বিপ্লব (Digital Revolution) বা তৃতীয় শিল্প বিপ্লব (Third Industrial Revolution) বলতে বিংশ শতাব্দীর শেষভাগে এসে (১৯৮০-র দশকের শুরুতে এসে) সারা বিশ্বে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তির ক্ষেত্রে বিভিন্ন যন্ত্রপাতি আবিষ্কারের মাধ্যমে অর্থনীতি ও যোগাযোগে অমূল পরিবর্তন সাধিত হয় যা ২১শ শতকের প্রথম দুই দশকব্যাপি অব্যাহত থাকে। এখানে ডিজিটাল কম্পিউটারের মাধ্যমে তথ্য ও উপাত্ত প্রক্রিয়াজাতকরণ এবং বিভিন্ন যোগাযোগ ও তথ্য সম্প্রচার মাধ্যমে ডিজিটাল টেলিযোগাযোগ প্রযুক্তির প্রসারের মাধ্যমে ব্যবসা, শিল্পখাত, অর্থনীতিসহ মানবসমাজের প্রতিটি স্তরে যে ব্যাপক পরিবর্তন ঘটে, সেটিকে বোঝাতেও "ডিজিটাল বিপ্লব" কথাটি ব্যবহার করা হয়।
ডিজিটাল মুঠোফোন এবং বিশ্বব্যাপী কম্পিউটারের আন্তর্জাল বা ইন্টারনেটের ব্যাপক ব্যবহার ডিজিটাল বিপ্লব আনয়নে কেন্দ্রীয় ভূমিকা রেখেছে। এই ডিজিটাল বিপ্লবের ফলে মানবজাতির ইতিহাসে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তির মাধ্যমে পৃথিবী গ্লোবাল ভিলেজে পরিণত হওয়া শুরু করে।
চতুর্থ শিল্প বিপ্লব (বা ইন্ডাস্ট্রি ৪.০) হলো আধুনিক স্মার্ট প্রযুক্তি ব্যবহার করে প্রচলিত উৎপাদন এবং শিল্প ব্যবস্থার অটোমেশন বা স্বয়ংক্রিয়করণের একটি চলমান প্রক্রিয়া। যেখানে স্বয়ংক্রিয়করণ , উন্নত যোগাযোগ, স্ব-পর্যবেক্ষণ ব্যবস্থা ও মানুষের হস্তক্ষেপ ছাড়াই সমস্যার বিশ্লেষণ এবং নিরুপণ করতে সক্ষম স্মার্ট মেশিন তৈরীর জন্য বৃহৎ পরিসরে মেশিন-টু-মেশিন (এমটুএম) যোগাযোগ এবং ইন্টারনেট অফ থিংস (আইওটি) কে একসাথে করা হয়েছে। এই অটোমেশন বা স্বয়ংক্রিয়করণ প্রক্রিয়ার মাধ্যমে আগামীতে অধিকাংশ কাজই মেশিনের মাধ্যমে করা হবে। যেমন- স্ব-চালিত গাড়ি, ড্রোন, স্বয়ংক্রিয় অপারেশন, মেশিনগুলো নিজেই নিজের সমস্যাগুলো নির্ণয় করতে পারবে। এটার অনেক সুবিধার পাশাপাশি কিছু অসুবিধাও থাকবে। এই পর্যায়ের মেশিনগুলো অনেক ব্যয়বহুল হবে। যন্ত্রভিত্তিক উৎপাদন হওয়ার কারণে অনেকেই চাকরি হারাতে পারেন। সমাজে বৈষম্য বাড়তে পারে।
পৃথিবী সব সময় সামনের দিকেই যায়। বিগত বিপ্লবগুলো ক্রম-ধারাবাহিকতায় পৃথিবীকে এগিয়েই দিয়েছে। সেভাবেই চতুর্থ শিল্প বিপ্লব মানবজাতিকে পাশবিক দৃষ্টিভঙ্গি থেকে মানবিক দৃষ্টিভঙ্গিতে রূপান্তরিত করবে। শ্রমই সভ্যতার স্রষ্টা। অতীতের শ্রম ছিল দেহ নির্ভর কিন্তু বর্তমানের শ্রম মেশিন নির্ভর যেটা বুদ্ধি দ্বারা পরিচালিত হয়। প্রচলিত সমাজ মানুষের দেহকে প্রাধান্য দিলেও ক্রমেই বর্তমান সমাজ মানুষের গুণ বা বুদ্ধিকে আইন-কানুন, নীতি-নৈতিকতাসহ সর্বত্র প্রাধান্য দিতে শুরু করেছে। তাই চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের হাত ধরে মানুষ দেহজ সীমা থেকে বেরিয়ে মস্তিষ্কপ্রসূত মানবিক বা মনুষ্যত্বসম্পন্ন সমাজ বিনির্মাণ করতে পারবে বলে আশা করা যায় ।
আমার বাঙলা/ এসএ