সমবায়ভিত্তিক রাষ্ট্রয়ত্ব দুগ্ধ ও দুগ্ধজাত পণ্য উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান মিল্ক ভিটা ঘুরে দাঁড়ানোর নিরন্তর চেষ্টা করে যাচ্ছে। বিগত আওয়ামী ফ্যাসিস্ট আমলে প্রতিষ্ঠানটি শেখ হাসিনার চাচা শেখ নাদির হোসেন লিপুর খপ্পরে পড়ে প্রায় সর্বশান্ত হয়ে যায়। নানা রকম প্রকল্প গ্রহণ করে শত শত কোটি টাকা লুটপাটের অভিযোগ রয়েছে মিল্ক ভিটার সাবেক চেয়ারম্যান শেখ নাদির হোসেন লিপুর নামে। জুলাই অভ্যুত্থানের পর পলাতক এই চেয়ারম্যান প্রতিষ্ঠান থেকে দূর হলেই মিল্ক ভিটাকে ঘুরে দাঁড়াতে বেগ পেতে হচ্ছে।
নানা ধরণের দুর্নীতি ও অনিয়মের কারণে প্রতিষ্ঠানটি ইতিমধ্যেই খাদের কিনারে এসে দাঁড়িয়েছে। শেখ নাদির হোসেন লিপুর বিরুদ্ধে রয়েছে অনিয়ম-দুর্নীতির নানা অভিযোগ। তার বিরুদ্ধে গত ১০ বছরে শত কোটি টাকা আত্মসাতের অভিযোগ রয়েছে। ইতোমধ্যে ওই অভিযোগের তদন্ত শুরু হয়েছে। তার আমলে মিল্ক ভিটায় ১০৫ কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মিত পাউডার প্ল্যান্টটি (গুঁড়া দুধ) চালুর দিনেই বন্ধ হয়ে যায়। কর্মচারীদের অভিযোগ নিম্নমানের যন্ত্রাংশ দিয়ে তৈরির কারণেই প্ল্যান্টটি চালু করা যায়নি।
মিল্ক ভিটাকে আরও উন্নত করতে, দুগ্ধজাত পণ্যের প্রসার ঘটাতে এবং দিনে দুই লাখ লিটার তরল দুধকে গুঁড়া দুধে রূপান্তরের লক্ষ্যমাত্রা নিয়ে সিরাজগঞ্জের বাঘাবাড়ীতে ২০১৫-১৬ অর্থবছরে মেগা প্রকল্প সুপার ইস্টার্ন পাউডার প্ল্যান্ট শুরু করেন তৎকালীন চেয়ারম্যান শেখ নাদির হোসেন লিপু। ১০৫ কোটি টাকা ব্যয়ে প্ল্যান্ট স্থাপনকাজের মেয়াদ ছিল দুই বছর। প্ল্যান্টটির অবকাঠামোগত কাজ ২০১৮ সালে শেষ হলেও এর যন্ত্রাংশ কেনা নিয়ে বাধে জটিলতা। অধিকাংশ যন্ত্রাংশ জার্মানি থেকে কেনার কথা থাকলেও শেখ নাদির হোসেন লিপুর নির্দেশে ভারত থেকে কেনা হয় নিম্নমানের যন্ত্রাংশ। ২০২৩ সালে প্রাথমিকভাবে ট্রায়ালে গেলে আগুন ধরে যায় মেশিনে। এর পর থেকে বন্ধ করে রাখা হয়েছে প্ল্যান্টটি। মরিচা ধরে গেছে অধিকাংশ যন্ত্রপাতিতে। পরে যন্ত্রপাতির কেনাকাটায় ব্যাপক দুর্নীতির অভিযোগ ওঠে। বারবার মেয়াদ বাড়িয়ে শেষ পর্যন্ত ৮ বছরেও প্ল্যান্টটি চালু করতে পারেনি মিল্ক ভিটা। বর্তমানে এটি অযত্ন-অবহেলায় পড়ে রয়েছে। একদিকে প্ল্যান্ট তো চালু হয়নি, তার ওপর কাজ শেষ করার আগে তুলে নেওয়া হয়েছে বরাদ্দ। ফলে ডুবেছে কোম্পানি।
এ ছাড়াও বাঘাবাড়ি কেন্দ্রিক গাভী ঋণ প্রকল্প, রায়পুর-টেকেরহাটের মহিষ প্রকল্প, কৃষকদের প্রজনন বীজ প্রকল্প, পাবনার বাথান জমি, বিভিন্ন ভ্যাকসিন-ওষুধ সরবারহসহ এমন নানান প্রকল্প থেকে দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতির মাধ্যমে কোটি কোটি টাকা লুটপাট করেছেন শেখ নাদির হোসেন লিপু এন্ড গং।
এ বিষয়ে স্থানীয় খামারিরা বলেন, বিভিন্ন সময় পরিকল্পিতভাবে অর্থ আত্মসাতের উৎস হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে মিল্ক ভিটাকে। যে টাকার দুর্নীতি হয়েছে এই টাকা মিল্ক ভিটার ক্ষতিগ্রস্ত খামারিদের ঋণ পরিশোধে খরচ করতে হবে। সেই সঙ্গে যারা দুর্নীতির সঙ্গে জড়িত তাদের বিরুদ্ধে শাস্তির ব্যবস্থা করতে হবে।
এদিকে দুর্নীতি ও অনিয়মের কারণে খামারিদের আস্থা হারিয়েছে প্রতিষ্ঠানটি। বর্তমান ব্যবস্থাপনা পরিষদ খামারিদের আস্থা ফিরিয়ে আনতে নানা রকম পদক্ষেপ নিচ্ছে বলে জানা গেছে। জুলাই অভ্যুত্থানের পর মিল্ক ভিটা পেয়েছে নতুন অন্তর্বতী ব্যবস্থাপনা কমিটি। কমান্ডার জাহিরুল আলিমকে চেয়ারম্যান করে ৬ সদস্য বিশিষ্ট কমিটিতে আরো রয়েছেন শাহাজাদপুর সমবায় থেকে মোঃ মোস্তাফিজুর রহমান ও জেড ওয়াই খান মজলিস এবং সংশ্লিষ্ট মন্ত্রনালয় থেকে আরো ৩ জন।
জানা গেছে, ১৯৭৩ সালে প্রতিষ্ঠিত মিল্ক ভিটার বর্তমান অন্তর্বতী ব্যবস্থাপনা কমিটি খামারিদের জন্য বেশ কিছু উদ্যোগ নিয়েছে। তার মধ্যে খামারিদের ৫ টাকা দুধের দাম বাড়ানো, সুলভ মূল্যে প্রজনন বীজ বিতরণ, ক্রিমিনাশকসহ প্রয়োজনীয় সব ভ্যাকসিন সরবরাহ, বন্ধ হয়ে যাওয়া ‘নো লস নো প্রফিট’ প্রকল্প পূণরায় চালু ইত্যাদি।
এ ছাড়া নতুন করে আইসক্রিম প্ল্যান্ট ও মিনারেল ওয়াটার প্ল্যান্ট চালুর উদ্যোগ নিয়েছে বর্তমান ব্যবস্থাপনা কমিটি।
অন্তর্বতী ব্যবস্থাপনা কমিটির অন্যতম সদস্য মিল্ক ভিটার পরিচালক মোঃ মোস্তাফিজুর রহমান আমার বাঙলাকে জানান, শেখ নাদির হোসেন লিপুর লাগামহীন দুর্নীতির কারণে মিল্ক ভিটা খাদের কিনারে এসে দাঁড়িয়েছে। এখন যারা ব্যবস্থাপনা কমিটিতে আছেন, সবাই অত্যন্ত অভিজ্ঞ এবং সৎ মানুষ। আমরা নানান ধরণের উদ্যোগ গ্রহণ করেছি মিল্ক ভিটাকে পুনরুজ্জীবিত করতে। আশা করছি মিল্ক ভিটা শিগগিরই আবার ঘুরে দাঁড়াবে।
তিনি বলেন, আমি ইতোমধ্যেই গত দুই মাসে খামারিদের সঙ্গে পনেরো-বিশটা উঠোন বৈঠক করেছি। আওয়ামী ফ্যাসিস্টদের দুর্নীতির কারণে খামারিদের মধ্যে যে আতঙ্ক তৈরি হয়েছিল, তা কাটতে শুরু করেছে। দুধের সরবারহ বেড়েছে। গত রমজানে যেখানে বাঘাবাড়ি প্লান্ট থেকে মাত্র ছয়-সাত হাজার লিটার দুধ পাওয়া যেত, এবার সেটা সর্বোচ্চ ৫৫ হাজার লিটারে উন্নিত হয়েছে। আশা করছি সঙ্কট কেটে যাবে।
মোঃ মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, দুর্নীতি অনিয়মের কারণে মিল্ক ভিটা ঠিক কতটা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, তা এখনি বলা যাচ্ছে না। ইতোমধ্যেই বিভাগীয় তদন্ত কমিটি গঠিত হয়েছে। আগামী দিন দশেকের মধ্যে এ কমিটি রিপোর্ট দিবে বলে আশা করছি। তখন সুনির্দিষ্টভাবে বোঝা যাবে ঠিক কতটুকু দুর্নীতি হয়েছে।
জানা গেছে, পাওডার প্লান্ট এর অসমাপ্ত কাজ শেষ করার উদ্যোগ নিয়েছে বর্তমান অন্তর্বর্তী ব্যবস্থাপনা কমিটি। যে ভারতীয় ঠিকাদার কাজটি পেয়েছিল, তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়েছে। শিগগিরই এই প্লান্ট উৎপাদনমুখী হবে।
এ ছাড়াও খামারিদের প্রাথমিক সমিতির মাধ্যমে আবারো নির্বাচন ফিরিয়ে আনা হবে।
এ বিষয়ে মোঃ মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, শেখ হাসিনা যেমন বাংলাদেশ থেকে নির্বাচনের সংস্কৃতি ধ্বংস করে দিয়েছিলেন, একইভাবে তার চাচা শেখ নাদির হোসেন লিপুও মিল্ক ভিটা থেকে নির্বাচন তুলে দিয়েছিলেন। আমরা প্রতিষ্ঠানটির গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় ফিরে যাবো।
রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টতা দেশের আর দশটা প্রতিষ্ঠানের মতো মিল্ক ভিটাকেও নিঃস্ব করেছে। জুলাই অভ্যুত্থানের পর মিল্ক ভিটার যে নতুন ব্যবস্থাপনা কমিটি এসেছে, সে কমিটি নিয়েও অনেকের রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টতার অভিযোগ রয়েছে। তবে সেসব অভিযোগ অস্বীকার করে মোঃ মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, বর্তমান ব্যবস্থাপনা কমিটি সম্পূর্ণ অরাজনৈতিক এবং সংশ্লিষ্ট কাজে অভিজ্ঞ। ১৯৯১ সালে কামরুদ্দিন এহিয়া খান মজলিশ প্রতিষ্ঠানটির চেয়ারম্যান হিসেবে নিয়োগ পাওয়ার পর মিল্ক ভিটা তার স্বর্ণ যুগ কাটিয়েছে। ১৯৯৬ সালে তিনি প্রতিষ্ঠান থেকে বিদায় নেওয়ার পর শুরু হয়েছে অধঃপতন। আমরা সর্বোচ্চ চেষ্টা করছি মিল্ক ভিটার সেই স্বর্ণযুগ ফিরিয়ে আনতে। সবার সহযোগিতা পেলে সেটা সম্ভব হবে ইনশাআল্লাহ।
আমার বাঙলা/ এসএ