চাহিদার অতিরিক্ত সক্ষমতার বিদ্যুৎকেন্দ্র থাকার পরও প্রয়োজনীয় জ্বালানির অভাবে সামনের গরমের সময় বিদ্যুৎসংকটে লোডশেডিং বাড়বে বলে শঙ্কা প্রকাশ করছেন খাত সংশ্লিষ্টরা।
জ্বালানি আমদানির অনিশ্চয়তা ও বেসরকারি বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোর বকেয়া পরিশোধে বিলম্বের কারণে গ্রীষ্মে সারা দেশে ব্যাপক লোডশেডিংয়ের শঙ্কা রয়েছে বলে জানান তারা।
তাদের মতে, সংকটের মূলে রয়েছে জ্বালানিসংকট, বিপুল পরিমাণ দেনার বোঝা এবং ডলার সংকট। পরিস্থিতি যতটা সম্ভব সামাল দেওয়ার চেষ্টা চলছে বলে জানিয়েছে বিদ্যুৎ বিভাগ।
বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের (বিপিডিবি) কর্মকর্তারা বলছেন, এবার গরমে তিন হাজার মেগাওয়াটের বেশি ঘাটতি থাকতে পারে। যদিও বিদ্যুৎ বিভাগ বলছে, লোডশেডিং হবে দেড় হাজার মেগাওয়াট। জ্বালানি সমস্যার কারণে বিদ্যুতের ঘাটতির শঙ্কা সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের।
বিদ্যুৎ বিভাগ সূত্র বলছে, মার্চে সর্বোচ্চ ১৬ হাজার এবং এপ্রিলে ১৮ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুতের চাহিদা ধরা হয়েছে।
গত বছর একই সময় ১২ থেকে ১৪ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন করা হয়েছে। এবার এটি ১৩ থেকে ১৫ হাজার মেগাওয়াট হতে পারে। ঘাটতি পূরণে আগের মতো এবারের গ্রীষ্মেও লোডশেডিং করতে হতে পারে।
বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ উপদেষ্টা মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান সম্প্রতি বিদ্যুৎ ভবনে গ্রীষ্মের প্রস্তুতি নিয়ে অনুষ্ঠিত সভা শেষে সাংবাদিকদের বলেন, এক হাজার ৪০০ মেগাওয়াট পর্যন্ত লোডশেডিং হতে পারে।
বিদ্যুৎ ঘাটতি মেটাতে এসি ব্যবহারে সতর্ক করেছেন তিনি। তাপমাত্রা ২৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসের নিচে রাখলে সংযোগ বিচ্ছিন্ন করা হবে।
সম্প্রতি জেলা প্রশাসক সম্মেলনের একটি অধিবেশনে অংশ নেওয়ার পর জ্বালানি উপদেষ্টা বলেন, শীত মৌসুমে দেশে বিদ্যুতের চাহিদা থাকে নয় হাজার মেগাওয়াট। কিন্তু দুটি কারণে গ্রীষ্মে চাহিদা বেড়ে ১৭ হাজার থেকে ১৮ হাজার মেগাওয়াট হয়ে যায়। সেচে দুই হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ লাগে।
পাঁচ থেকে ছয় হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ লাগে এসি চালানোয়। এসির তাপমাত্রা ২৫ ডিগ্রির ওপরে রাখলে দুই থেকে তিন হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ সাশ্রয় করা যাবে।
বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের সদস্য (উৎপাদন) মো. জহুরুল ইসলাম বলেন, ‘বিদ্যুতের চাহিদা বাড়ায় উৎপাদনও বাড়ানো হয়েছে। বড় বড় কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র চালু রয়েছে। আদানি পাওয়ারের দুটি ইউনিট থেকেই বিদ্যুৎ সরবরাহ করা হচ্ছে। এতে এখন লোডশেডিং নেই। গ্রীষ্মে বিদ্যুতের চাহিদা বাড়বে। এ ব্যাপারে নানা পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে।’
বিদ্যুতের ব্যবহার ১৫ শতাংশ পর্যন্ত কমিয়ে গ্রীষ্মের চাপ মোকাবেলা করতে চায় সরকার। শীত মৌসুমে দেশে বিদ্যুতের চাহিদা থাকে নয় হাজার মেগাওয়াট। কিন্তু গ্রীষ্মে এ চাহিদা বেড়ে দ্বিগুণ হয়ে যায়। এ কারণে শিল্প খাত, সেচ ও জনসাধারণের ব্যক্তিগত ব্যবহারে সাশ্রয়ী পদ্ধতি অবলম্বন করে বিদ্যুতের ব্যবহার ১৫ শতাংশ কমাতে চায় সরকার। এ জন্য বিদ্যুৎ সাশ্রয়ে বিভিন্ন উপায় সংবলিত কর্মপরিকল্পনা তৈরি করেছে বিদ্যুৎ বিভাগ। এর মধ্যে রয়েছে জ্বালানি-সাশ্রয়ী বাল্ব, ফ্যান ও হোম অ্যাপ্লায়েন্সের ব্যবহার বাড়ানো; এসির তাপমাত্রা ২৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস বা তার বেশি নির্ধারণ, সৌরবিদ্যুত্চালিত সেচযন্ত্রের ব্যবহার উৎসাহিত করা, শিল্পে বয়লারের দক্ষতা ও ফার্নেস তেলের ব্যবহার বাড়ানো।
এই কর্মপরিকল্পনা বাস্তবায়নে বিদ্যুৎ বিভাগ থেকে দেশের সব জেলা প্রশাসক ও বিভিন্ন সংস্থার প্রধানদের কাছে বিদ্যুৎসচিব ফারজানা মমতাজ স্বাক্ষরিত চিঠি পাঠানো হয়েছে। চিঠিতে বলা হয়েছে, রমজান মাস, গ্রীষ্মকাল ও সেচ মৌসুমে বিদ্যুতের চাহিদা তুলনামূলকভাবে বেড়ে থাকে। অতিরিক্ত এই চাহিদা পূরণে বিদ্যুৎ সরবরাহের ওপর অতিরিক্ত চাপ পড়বে। পরিস্থিতি মোকাবেলার সহজ ও সর্বোত্তম উপায় সচেতন ও সাশ্রয়ীভাবে বিদ্যুৎ ব্যবহার।
চিঠিতে বিদ্যুৎ সচিব বলেন, সচেতনতামূলক কর্মসূচি গ্রহণের মাধ্যমে বিদ্যুৎ গ্রাহকদের সাশ্রয়ী ব্যবহারে উদ্বুদ্ধ ও অনুপ্রাণিত করা প্রয়োজন। তিনি বলেন, এক ইউনিট বিদ্যুৎ সাশ্রয়ের উপযোগিতা আড়াই থেকে তিন ইউনিট বিদ্যুৎ উৎপাদনের সমতুল্য।
তবে বিপিডিবি ও বিভিন্ন বিদ্যুৎকেন্দ্রের কর্মকর্তারা বলছেন, এবার লোডশেডিং গতবারের চেয়ে বাড়তে পারে। গ্যাস ও কয়লা থেকে ১৩ হাজার মেগাওয়াট উৎপাদনের পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে। যদিও গ্যাস ও কয়লার সরবরাহ নিয়ে অনিশ্চয়তা আছে। আদানি বিদ্যুৎকেন্দ্রের বাইরে আমদানি থেকে আসবে প্রায় এক হাজার মেগাওয়াট। বাকি বিদ্যুৎ উৎপাদন করতে হবে তেলচালিত কেন্দ্র থেকে। বিদ্যুৎকেন্দ্রের বকেয়া বিল পরিশোধ ও জ্বালানি সরবরাহ নিশ্চিত করতে না পারলে তিন হাজার মেগাওয়াট ঘাটতি হতে পারে। এতে গরমের সময় প্রতিদিন তিন ঘণ্টা লোডশেডিং হতে পারে।
বিদ্যুৎ বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, বর্তমানে বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতা ২৭ হাজার ৮২০ মেগাওয়াট। এখন পর্যন্ত দিনে সর্বোচ্চ বিদ্যুৎ উৎপাদন হয়েছে গত বছরের ৩০ এপ্রিল, ১৬ হাজার ৪৭৭ মেগাওয়াট। এরপর আর কখনো ১৬ হাজার মেগাওয়াটে যায়নি উৎপাদন; বরং বিদ্যমান সংকটের কারণে সক্ষমতার অর্ধেক বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে উৎপাদন করা কঠিন হয়ে যাচ্ছে।
বর্তমানে বিপিডিবির কাছে বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোর বকেয়া প্রায় ১৬ হাজার কোটি টাকা, যার মধ্যে শুধু ফার্নেস অয়েলচালিত বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোর পাওনা প্রায় ছয় হাজার কোটি টাকা। বিদ্যুৎকেন্দ্র চালাতে জ্বালানি আমদানি নিয়ে হিমশিম খাচ্ছেন মালিকরা।
বেসরকারি বিদ্যুৎকেন্দ্র মালিকদের সংগঠন বাংলাদেশ ইন্ডিপেনডেন্ট পাওয়ার প্রডিউসার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিআইপিপিএ) সভাপতি ডেভিড হাসানাত বলেন, ‘বিপিডিবির কাছে আমাদের এখনো চার থেকে পাঁচ মাসের বকেয়া আটকে আছে। শুধু ফার্নেস অয়েলভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোর বকেয়ার পরিমাণ প্রায় ছয় হাজার কোটি টাকা। গ্রীষ্মের জন্য সরকার আমাদের কাছ থেকে তিন হাজার থেকে সাড়ে তিন হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ চেয়েছে। কিন্তু আমরা বলে দিয়েছি দুই হাজার থেকে আড়াই হাজার মেগাওয়াটের বেশি বিদ্যুৎ দিতে পারব না। গত বছর পর্যাপ্ত তেল আমদানি করতে পারার কারণে এর চেয়ে বেশি বিদ্যুৎ দেওয়া হয়েছিল। আমাদের সক্ষমতা রয়েছে পাঁচ হাজার মেগাওয়াটের মতো।’
খাতসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, বিগত আওয়ামী লীগ সরকার একের পর এক প্রয়োজনের অতিরিক্ত বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ করলেও জ্বালানির সংস্থানে নজর দেয়নি। অপ্রয়োজনীয় বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ ও আমদানি প্রবণতার কারণে উৎপাদন ব্যয় বৃদ্ধির পাশাপাশি বেড়েছে বকেয়ার পরিমাণ। বিদ্যুৎ-জ্বালানি খাতের এমন নাজুক পরিস্থিতি মোকাবেলায় কার্যত অসহায় হয়ে পড়েছে অন্তবর্তী সরকার।
বিদ্যুৎ বিভাগের সচিব ফারজানা মমতাজ বলেন, সম্ভাব্য যতটুকু বিদ্যুৎ পাব, এর ওপর ভিত্তি করেই পরিকল্পনা করছি, যাতে সাধারণ মানুষকে সর্বোচ্চ ‘কমফোর্ট’ দেওয়া যায়। গ্রাহককে নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সরবরাহ করতে সব ধরনের চেষ্টা করছে সরকার। তিনি বলেন, গ্রীষ্মে বিদ্যুতের চাহিদা বাড়বে। আবার জ্বালানিরও সংকট রয়েছে। ফলে লোডশেডিং হতেই পারে। তবে যতটা সম্ভব লোডশেডিং কমানোর পরিকল্পনা করা হচ্ছে।
গরমে বিদ্যুতের পাশাপাশি গ্যাসও ভোগাবে গ্রাহককে, বিশেষ করে শিল্প ও আবাসিকে। পেট্রোবাংলা সূত্র বলছে, বর্তমানে দেশে গ্যাসের দৈনিক চাহিদা রয়েছে চার হাজার ২০০ মিলিয়ন ঘনফুট। কিন্তু বুধবার গ্যাস সরবরাহ করা হয় দুই হাজার ৭৭৭ মিলিয়ন ঘনফুট। এতে ওই দিন ঘাটতি ছিল এক হাজার ৪২৩ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাসের মতো। মোট দুই হাজার ৭৭৭ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস সরবরাহের মধ্যে দেশীয় গ্যাসক্ষেত্র থেকে এক হাজার ৯০০ মিলিয়ন ঘনফুট এবং আমদানিকৃত তরলীকৃত প্রকৃতিক গ্যাস (এলএনজি) থেকে ৮৭৭ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস সরবরাহ করা হয়। আপাতত দেশীয় গ্যাসের উৎপাদন বাড়ানো সম্ভব নয়, তবে এলএনজির সরবরাহ সর্বোচ্চ আর মাত্র ১০০ থেকে ১৫০ মিলিয়ন ঘনফুটের মতো বাড়ানো সম্ভব। কারণ ভাসমান দুটি এলএনজি টার্মিনালের সক্ষমতা রয়েছে ১১০০ মিলিয়ন ঘনফুট। এতে সরকার চাইলেই বাড়তি এলএনজি সরবরাহ বাড়াতে পারবে না। ফলে গ্রীষ্ম মৌসুমে গ্যাসের সংকট থাকবে। গরমে বাড়তি গ্যাসের পুরোটাই বিদ্যুৎ খাতে যাবে বলে শিল্প ও আবাসিকে সংকট বাড়বে।
জাতীয় গ্রিডে বিদ্যুৎ সঞ্চালনের দায়িত্বে থাকা একমাত্র রাষ্ট্রীয় সংস্থা পাওয়ার গ্রিড কোম্পানি অব বাংলাদেশের (পিজিসিবি) বিদ্যুৎ উৎপাদন ও চাহিদার তথ্যে দেখা গেছে, তাপমাত্রা বৃদ্ধি পাওয়ায় গত এক মাসের ব্যবধানে দেশে বিদ্যুতের চাহিদা দুই হাজার মেগাওয়াটের বেশি বেড়েছে। একই সঙ্গে বিদ্যুতের উৎপাদনও বাড়িয়েছে বিপিডিবি। বুধবার দুপুর ২টার দিকে বিদ্যুতের চাহিদা ছিল ১৩ হাজার ১৩৫ মেগাওয়াট। এ সময় উৎপাদন হয় ১৩ হাজার ৭০ মেগাওয়াট। তখন লোডশেডিং ছিল ৬৫ মেগাওয়াটের মতো। এদিকে গত ১২ ফেব্রুয়ারি দুপুর ২টায় বিদ্যুতের চাহিদা ছিল ১০ হাজার ৯৬৫ মেগাওয়াট।
সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, পিজিসিবির দৈনিক প্রতিবেদনে লোডশেডিংয়ের সঠিক তথ্য তুলে ধরা হচ্ছে না। পিজিসিবির তথ্যে লোডশেডিং কম দেখানো হলেও রমজানে দেশের গ্রামাঞ্চলে দিন-রাত মিলিয়ে একাধিকবার লোডশেডিং হচ্ছে বলে জানা গেছে।
আগামী জুন থেকে বাংলাদেশে আনুষ্ঠানিকভাবে ৪০ মেগাওয়াট জলবিদ্যুৎ রপ্তানি শুরু করবে নেপাল। বিপিডিবি সূত্র বলছে, জুন থেকে নভেম্বর পর্যন্ত বাংলাদেশে বিদ্যুৎ সরবরাহ করবে নেপাল। নেপাল থেকে প্রতি ইউনিট বিদ্যুৎ বাংলাদেশ কিনবে আট দশমিক ১৭ রুপিতে। এর মধ্যে ভারতের সঞ্চালন লাইনের খরচও থাকবে।
বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান বলেন, ‘শুধু গ্রীষ্মকালের জন্যই নেপাল থেকে ৪০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ আমদানির চুক্তি হয়েছে। চুক্তি অনুযায়ী জুন থেকে সরবরাহ করবে নেপাল। এই সময় দেশে বাড়তি বিদ্যুতের চাহিদার বিষয়টি বিবেচনায় নিয়েই এই চুক্তি করা হয়।’
আমারবাঙলা/এমআরইউ