ক্রীড়া ডেস্ক: ওবেড ম্যাককয় বলটি করলেন একদম স্লটে। ফায়দা নিতে ভুল করলেন না মার্কো ইয়ানসেন। বোলারে মাথার ওপর দিয়ে ছক্কায় উড়িয়ে গর্জন করে উঠলেন তিনি। ডাগ আউটে উল্লাসে মেতে উঠলেন তার সতীর্থরা। কিন্তু স্যার ভিডিয়ান রিচার্ডস স্টেডিয়ামের উচ্ছ্বাস মিইয়ে গেল। শত শত বাদ্য থেমে গেল, হাজার হাজার মুখের হাসি মিলিয়ে গেল। ভেসে এলো স্রেফ গুটিকয় দক্ষিণ আফ্রিকা সমর্থকের আনন্দ-ধ্বনি। ইয়ানসেনের ওই ছক্কায় উত্তেজনাময় ম্যাচ জিতে সেমি-ফাইনালে পৌঁছে গেল দক্ষিণ আফ্রিকা।
স্বাগতিক ওয়েস্ট ইন্ডিজ বিদায় নিল সুপার এইট থেকেই। বৃষ্টি, রান তাড়া, ডাকওয়ার্থ-লুইস আর কার্যত নক-আউট ম্যাচ, এই সবকিছু মিলে যাওয়া মানে দক্ষিণ আফ্রিকার বেদনা ও বিভীষিকার ইতিহাস। বিশ্ব আসরে কতবারই তো এসব মুহূর্তে ভেঙে পড়ে ‘চোকার’ তকমা পেয়ে গেছে তারা। তবে এবার এই দল ব্যতিক্রম। অ্যান্টিগায় কোয়ার্টার-ফাইনালে রূপ নেওয়া ম্যাচে ওয়েস্ট ইন্ডিজকে ৩ উইকেটে হারিয়ে সেমি-ফাইনালে পা রাখল দক্ষিণ আফ্রিকা। যার নেতৃত্বে ২০১৪ সালে অনূর্ধ্ব-১৯ বিশ্বকাপের শিরোপা জয় করে প্রোটিয়ারা, সেই এইডেন মার্করামের নেতৃত্বে জাতীয় দলও এবার ইতিহাস গড়ার পথে এগিয়ে গেল আরেক ধাপ।
স্যার ভিভিয়ান রিচার্ডস স্টেডিয়ামে বাংলাদেশ সময় সোমবার সকালে দুর্দান্ত বোলিংয়ে ক্যারিবিয়ানদের ১৩৫ রানে আটকে রাখে দক্ষিণ আফ্রিকা। প্রোটিয়াদের রান তাড়ায় দুই ওভারের পর বৃষ্টি নেমে বন্ধ হয়ে যায় খেলা। পরে ডাকওয়ার্থ-লুইস-স্টার্ন পদ্ধতিতে নতুন লক্ষ্য নির্ধারিত হয় ১৭ ওভারে ১২৩। নানা নাটকীয়তা পেরিয়ে সেই লক্ষ্য ছুঁয়ে ফেলে তারা ৫ বল বাকি রেখে। উইকেট ও কন্ডিশন বুঝে এই ম্যাচের একাদশে তাব্রেইজ শামসিকে ফেরায় দক্ষিণ আফ্রিকা। তিন উইকেট নিয়ে ক্যারিবিয়ান ব্যাটিংয়ের মেরুদণ্ড ভেঙে দেন তিনিই। অন্য দুই স্পিনার কেশাভ মহারাজ ও মার্করামও ছিলেন দুর্দান্ত।
ওয়েস্ট ইন্ডিজের হয়ে দারুণ অলরাউন্ড পারফরম্যান্স দেখান রোস্টন চেইস। ব্যাট হাতে চমৎকার ফিফটির পর বল হাতে তার তিন উইকেট শেষ দিকে ঘুরিয়ে দেয় ম্যাচ। কিন্তু শেষ রক্ষা হয়নি তাদের। এই দক্ষিণ আফ্রিকা যে অন্যরকম! টানা সাত জয়ে তারা পৌছে গেল সেমি-ফাইনালে। এর মধ্যে পাঁচটি ম্যাচ তারা জিতেছে তুমুল উত্তেজনার মধ্যে শেষ মুহূর্তের চাপ সামলে। দক্ষিণ আফ্রিকার রান তাড়ার শুরুটা ছিল নাটকীয়। ইনিংসের প্রথম চার বলেই আকিল হোসেনকে তিন দফায় বাউন্ডারিতে পাঠান কুইন্টন ডি কক। পরের ওভারেই জোড়া ধাক্কায় প্রোটিয়াদের নাড়িয়ে দেন আন্দ্রে রাসেল। লেগ স্টাম্পের বাইরের বলে উইকেটে পেছনে ক্যাচ দেন রিজা হেনড্রিকস (গোল্ডেন ডাক)। প্রিয় হুক শটে সীমানায় ধরা পড়েন ডি কক (৭ বলে ১২)।
এরপরই বৃষ্টিতে বন্ধ হয় খেলা। বিরতির পর মার্করাম ও ট্রিস্টান স্টাবস শুরু করেন ইতিবাচকভাবে। পাওয়ার প্লের ৫ ওভারে রান আসে ৪১। কিন্তু আলজারি জোসেফ বল হাতে নিয়েই থামান মার্করামকে (১৫ বলে ১৮)। হাইনরিখ ক্লসেন গিয়ে শুরু করেন সেটাই, যেটা তিনি সবচেয়ে ভালো পারেন। গুডাকেশ মোটির প্রথম বলই আছড়ে ফেলেন তিনি সাইটস্ক্রিনে। বাঁহাতি স্পিনারের ওই ওভারে বাউন্ডারি মারেন তিনি আরও তিনটি।পরের ওভারে দারুণ এক বাউন্সারে ক্লসেনকে বিদায় করে গর্জনে ফেটে পড়েন জোসেফ। ওই ক্যামিও ইনিংসটি অবশ্য কমিয়ে দেয় দক্ষিণ আফ্রিকার চাপ। তবে রোস্টন চেইস আক্রমণে এসে আবার জমিয়ে দেন খেলা। ধুঁকতে থাকা ডেভিড মিলারকে (১৩ বলে ৪) বোল্ড করেন তিনি। পরে তিনি ফিরিয়ে দেন দারুণ খেলতে থাকা স্টাবসকেও (২৭ বলে ২৯)। একটু পরে যখন কেশাভ মহারাজকেও বিদায় করেন চেইস, উল্লাসে তখন ফেটে পড়ে গোটা স্টেডিয়াম। কিন্তু ওই ওভারেই শেষ বলে দুর্দান্ত শটে চার মেরে সমীকরণ সহজ করে দেন কাগিসো রাবাদা।
এরপর শেষ ওভারের প্রথম বলে ইয়ানসেনের ওই ছক্কায় ম্যাচ শেষ। ম্যাচের প্রথম ভাগে টস জিতে বোলিং নেয় দক্ষিণ আফ্রিকা। সাফল্য আসতেও দেরি হয়নি। আগের ম্যাচে ৮ ছক্কায় ৮২ রান করা শেই হোপকে এবার প্রথম ওভারেই শূন্য রানে ফেরান ইয়ানসেন। পরের ওভারে আক্রমণে আসেন দক্ষিণ আফ্রিকা অধিনায়ক মার্করাম নিজেই। প্রথম বলেই ক্রিজ ছেড়ে বেরিয়ে মারার চেষ্টায় আউট নিকোলাস পুরান। পরের ওভারে বিদায় নিতে পারতেন চেইসও। কিন্তু মিড অনে ক্যাচ নিতে পারেননি আনরিখ নরকিয়া। জীবন পেয়ে দলকে উদ্ধার অভিযানে নামেন চেইস।
সঙ্গী হন কাইল মেয়ার্স। প্রথম বলে বাউন্ডারিতে শুরু করা চেইস পাল্টা আক্রমণের পথ বেছে নেন। ব্রান্ডন কিং চোট পেয়ে ছিটকে পড়ায় বিশ্বকাপে সুযোগ পাওয়া মেয়ার্স শুরুতে একটু সময় নিয়ে পরে শট খেলেন। শুরুর জোড়া ধাক্কা সামলে পাওয়ার প্লেতে ৪৭ রান তোলে ওয়েস্ট ইন্ডিজ। এরপরই দুই ক্যারিবিয়ান ব্যাটসম্যানকে চেপে ধরেন প্রোটিয়া স্পিনাররা। পরের ৫ ওভারে রান আসে ২৬। দ্বাদশ ওভারে সেই চাপ উড়িয়ে দেওয়ার চেষ্টা করেন দুজনই। শামসিকে বাউন্ডারি মারেন মেয়ার্স, ছক্কায় ওড়ান চেইস। কিন্তু ভেঙে পড়ার শুরুও সেই ওভার থেকেই। মেয়ার্সকে ক্রিজ ছেড়ে বেরিয়ে আসতে দেখেই একটু টেনে বেশ বাইরে বল করেন শামসি। কাভার বাউন্ডারিতে সহজ ক্যাচ দেন মেয়ার্স (৩৪ বলে ৩৫)। জুটি থামে ৬৫ বলে ৮১ রানে। পরের ওভারে কেশাভ মহারাজের দারুণ ড্রিফটে স্টাম্পড হয়ে যান ক্যারিবিয়ান অধিনায়ক রভম্যান পাওয়েল (১)।
শামসি নিজের পরের দুই ওভারে শিকার ধরেন আরও দুটি। স্লিপে মার্করামের দারুণ ক্যাচে বিদায় নেন শেরফেন রাদারফোর্ড (০)। ফিফটি করা চেইস আউট হন স্লগ করে ছক্কার চেষ্টায় (৪২ বলে ৫২)। ১২ রানের মধ্যে ৪ উইকেট হারিয়ে বসে ক্যারিবিয়ানরা। রাসেল তখন বেছে নেন নিজের চেনা পথ। নরকিয়ার দেড়শ কিলোমিটার গতির দুটি বলে টানা দুটি ছক্কা মারেন তিনি চাবুকের মতো ব্যাট চালিয়ে। কিন্তু পরের ওভারেই আত্মঘাতী এক ঝুঁকিপূর্ণ রান নিতে গিয়ে থামে তার ইনিংস। নরকিয়ার গুলির মতো সরাসরি থ্রোয়ে রান আউট হয়ে হতাশায় মাথা নিচু করে বসে পড়েন তিনি (৯ বলে ১৫)।
রাবাদার ওই ওভারে বিদায় নেন আকিলও। পরে মোটির একটি বাউন্ডারি ও শেষ ওভারে জোসেফের ছক্কায় ১৩৫ পর্যন্ত যেতে পারে ক্যারিবিয়ানরা। সেই পুঁজি নিয়ে তারা লড়াই করে দারুণ। কিন্তু অপ্রতিরোধ্য এই দক্ষিণ আফ্রিকার সঙ্গে পেরে ওঠেনি। দেশের মাঠে তাদের শিরোপা স্বপ্নেরও তাই সমাধি। অধিনায়ক হিসেবে দুটি টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপজয়ী একমাত্র অধিনায়ক ড্যারেন স্যামি কোচ হিসেবে ব্যর্থ প্রথম অভিযানে। দক্ষিণ আফ্রিকা টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের সেমিতে উঠল ১০ বছর পর। এই গ্রুপ থেকে আগেই শেষ চার নিশ্চিত করেছে ইংল্যান্ড। এবার তাদের প্রতিপক্ষ ঠিক হওয়ার পালা অন্য গ্রুপ থেকে।
সংক্ষিপ্ত স্কোর:
ওয়েস্ট ইন্ডিজ: ২০ ওভারে ১৩৫/৯ (মেয়ার্স ৩৫, হোপ ০, পুরান ১, চেইস ৫২, পাওয়েল ১, রাদারফোর্ড ০, রাসেল ১৫, আকিল ৬, জোসেফ ১১*, মোটি ৪*; ইয়ানসেন ২-০-১৭-১, মার্করাম ৪-০-২৮-১, মহারাজ ৪-০-২৪-১, নরকিয়া ৪-০-২৬-০, শামসি ৪-০-২৭-৩, রাবাদা ২-০-১১-১)।
দক্ষিণ আফ্রিকা: (লক্ষ্য ১৭ ওভারে ১২৩) ১৬.১ ওভারে ১২৪/৭ (ডি কক ১২, হেনড্রিকস ০, মার্করাম ১৮, স্টাবস ২৯, ক্লসেন ২২, মিলার ৪, ইয়ানসেন ২১*, মহারাজ ২, রাবাদা ৫*; আকিল ৩-০-৩১-০, রাসেল ৪-০-১৯-২, জোসেফ ৪-০-২৫-২, মোটি ১-০-২০-০, ম্যাককয় ১.১-০-১৫-০, চেইস ৩-০-১২-৩)।
ফল: ডাকওয়ার্থ-লুইস-স্টার্ন পদ্ধতিতে দক্ষিণ আফ্রিকা ৩ উইকেটে জয়ী।
ম্যান অব দা ম্যাচ: তাব্রেইজ শামসি।
এবি/এইচএন