কক্সবাজারে সমুদ্র উপকূলে জালে আটকে পড়ে মারা যাচ্ছে গভীর সাগর থেকে সৈকতে ডিম পাড়তে আসা মা কাছিম। একটি বেসরকারি সংগঠনের তথ্যমতে, গত আড়াই মাসে সৈকতের ৫০টির বেশি পয়েন্টে ভেসে এসেছে ২৪০টির বেশি মা কাছিম। সব কটি অলিভ রিডলে প্রজাতির। এর মধ্যে ৯০ শতাংশ কাছিমের শরীরে আঘাতের চিহ্ন ও পেটে ডিম ছিল।
সম্প্রতি কক্সবাজার পৌরসভার ১ নম্বর ওয়ার্ডের নাজিরারটেক সৈকতে গিয়ে দেখা যায়, একটি মরা কাছিম ভেসে এসেছে। কাছিমের পেছনে একটি পা নেই। মাথাতেও আঘাতের চিহ্ন। কয়েকটি কুকুর মরা কাছিম নিয়ে টানাটানি করছে। দুর্গন্ধ ছড়িয়ে পড়ায় পরে মরা কাছিমটি বালুচরে পুঁতে ফেলেন স্থানীয় জেলেরা।
নাজিরারটেক এলাকার শুঁটকি ব্যবসায়ী কামাল উদ্দিন (৪৫) বলেন, প্রতিদিন নাজিরারটেক থেকে সমিতিপাড়া পর্যন্ত দুই কিলোমিটার সৈকতে এক-দুটি করে মরা কাছিম ভেসে আসতে দেখা যায়। মৃত কাছিমগুলো কুকুর খেয়ে ফেলে। আর কিছু কাছিম বালুতে পুঁতে ফেলেন স্থানীয় লোকজন।
সৈকতে ভেসে আসা মরা কাছিমের তথ্য সংগ্রহ করেন কক্সবাজার বন ও পরিবেশ সংরক্ষণ পরিষদের কর্মীরা। গত আড়াই মাসে মহেশখালীর সোনাদিয়া থেকে সেন্ট মার্টিন পর্যন্ত ১০০ কিলোমিটার সৈকতে ২৪০টির মতো মরা কাছিম ভেসে আসার তথ্য জানান সংগঠনটির সভাপতি দীপক শর্মা। তিনি বলেন, আগে সোনাদিয়া, কলাতলী, টেকনাফের বাহারছড়া ও সেন্ট মার্টিনে মরা কাছিম ভেসে আসত। এখন পর্যটকে জমজমাট থাকা সুগন্ধা, লাবণী ও কলাতলী পয়েন্টেও মরা কাছিম ভেসে আসছে। সৈকতজুড়ে মরা কাছিম পড়ে আছে। প্রতি এক কিলোমিটারে তিনটি করে মরা কাছিম ভেসে আসছে। এর মধ্যে ৯০ শতাংশ মরা কাছিমের শরীরে আঘাতের চিহ্ন এবং পেটে ডিম দেখা গেছে। কিন্তু কী কারণে এবং কীভাবে কাছিমের মৃত্যু হচ্ছে, তা নিয়ে কোনো গবেষণা নেই।
সংগঠনটির তথ্যমতে, গত জানুয়ারি মাসে ১৩৫টি ও ফেব্রুয়ারি মাসে ৮৭টি মরা কাছিম সৈকতে ভেসে আসে।
গত ১৯ ফেব্রুয়ারি গবেষণার কাজে সেন্ট মার্টিনে যান চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সমুদ্রবিজ্ঞান ইনস্টিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক ও গবেষক মোহাম্মদ শাহনেওয়াজ চৌধুরী। ওই দিন তিনি সেন্ট মার্টিন সৈকতে দুটি মরা কাছিম ভেসে আসতে দেখেন। তিনি বলেন, কাছিমের শরীরে ছেঁড়া জাল ও রশি মোড়ানো ছিল। অবকাঠামো নির্মাণসহ নানা কারণে সেন্ট মার্টিন দ্বীপে মা কাছিমের ডিম পাড়তে আসার উপস্থিতি অনেক কমেছে।
সমুদ্র উপকূলে মাছ ধরে ৬৫ হাজারের বেশি ট্রলার। বেশির ভাগ ট্রলারেই ফাঁসজাল ব্যবহার করা হয়। বাংলাদেশে প্রায় ২৫০টি ইন্ডাস্ট্রিয়াল ট্রলার আছে; যারা গভীর সাগরে ট্রল নেট (টানা জাল) দিয়ে মাছ ধরে।
কাছিম নিয়ে কাজ করেন এমন ব্যক্তিরা বলছেন, গভীর সমুদ্র থেকে উপকূলের দিকে ডিম দিতে আসার সময় ট্রল নেটে আটকে পড়ে মা কাছিমের মৃত্যু হচ্ছে। এ ছাড়া জাহাজ বা ট্রলারের আনাগোনা বাড়ার কারণে প্রপেলার কিংবা অন্য কিছুর ধাক্কায় আঘাত পায় কাছিম। এর পাশাপাশি অন্য প্রজাতি, বিশেষ করে হাঙরের মতো জলজ প্রাণীর আক্রমণ কিংবা দূষণের কারণেও কাছিম মারা যেতে পারে। এ নিয়ে গবেষণা দরকার। নভেম্বর থেকে মার্চ পর্যন্ত পাঁচ মাস অলভি রিডলে কাছিমের ডিম পাড়ার সময়।
সাগরে নিষিদ্ধ জালে আটকে পড়ে বহু কাছিমের মৃত্যু হচ্ছে বলে জানিয়েছেন পরিবেশ অধিদপ্তর কক্সবাজারের উপপরিচালক মো. জমির উদ্দিন। তবে এখন পর্যন্ত কতটি মরা কাছিম সৈকতে ভেসে এসেছে, তার পরিসংখ্যান তার দপ্তরে নেই বলে জানান তিনি।
সৈকত থেকে কাছিমের পাড়া ডিম সংগ্রহ করে হ্যাচারিতে সংরক্ষণের মাধ্যমে বাচ্চা ফোটানোর কাজ করে বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা নেচার কনজারভেশন ম্যানেজমেন্ট (নেকম)। নেকমের প্রাকৃতিক সম্পদ ব্যবস্থাপনা ও জলবায়ু পরিবর্তন ব্যবস্থাপক আবদুল কাইয়ুম বলেন, ডিসেম্বর মাসের শুরু থেকে কক্সবাজার সৈকতে মা কাছিমের ডিম পাড়া শুরু হয়েছে। কিন্তু সাগরের যত্রতত্র পুঁতে রাখা নিষিদ্ধ বিহিন্দি, ফাঁস ও কারেন্ট জালে আটকে পড়ে অসংখ্য মা কাছিমের মৃত্যু হচ্ছে। ১ ডিসেম্বর থেকে ১৫ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত আড়াই মাসে সৈকতের বিভিন্ন পয়েন্টে ১৩০টির বেশি মরা কাছিম ভেসে আসার তথ্য তাদের কাছে আছে।
বাংলাদেশ সমুদ্র গবেষণা ইনস্টিটিউটের বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা শিমুল ভূঁইয়া জানান, গত ২৪ ও ২৫ জানুয়ারি দুই দিনে সৈকতে ভেসে এসেছিল ৬৮টি মরা কাছিম।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, পেটে ডিম থাকে বলে হাজার কিলোমিটার দূর থেকে ছুটে আসা মা কাছিম ক্লান্ত থাকে। সামান্য আঘাতে কাছিমের মৃত্যু ঘটে।
প্রজনন মৌসুমে বিপুলসংখ্যক কাছিমের মৃত্যু উদ্বেগের উল্লেখ করে নেকমের উপপ্রকল্প পরিচালক শফিকুর রহমান বলেন, দিন দিন ডিম পাড়ার জায়গা সংকোচিত হয়ে পড়ছে।
সৈকতে ভেসে আসা বেশির ভাগ মরা কাছিম ও কাছিমের ডিম কুকুর ও গুইসাপ খেয়ে ফেলছে দাবি করে দীপক শর্মা বলেন, কক্সবাজার উপকূলের দেশি-বিদেশি কয়েক হাজার ট্রলার মাছ শিকার করছে নিষিদ্ধ ফাঁদজাল দিয়ে। এসব জালে আটকে পড়লে বাঁচার উপায় থাকে না সমুদ্র পরিবেশ রক্ষার ঝাড়ুদার হিসেবে পরিচিত শত শত মা কাছিমের। এ বিষয়ে জেলেদের সচেতন করার কোনো কর্মসূচি চোখে পড়ে না। সামুদ্রিক কাছিমের সুরক্ষার নামে বেসরকারি কয়েকটি সংস্থা বালুচর থেকে কাছিমের ডিম সংগ্রহ এবং ডিম থেকে বাচ্চা ফোটানোর প্রজননব্যবস্থা চালু রাখলেও মা কাছিমের মৃত্যু ঠেকানো যাচ্ছে না।
তবে জালে আটকে পড়লে আঘাত না করে কাছিম ছেড়ে দিতে ট্রলারের জেলেদের নির্দেশনা দেওয়া আছে বলে দাবি কক্সবাজার ফিশিংবোট মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক দেলোয়ার হোসেনের। তিনি বলেন, এরপরও কেন মা কাছিমের মৃত্যু হচ্ছে, তার কারণ অনুসন্ধান দরকার।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক মোহাম্মদ শাহনেওয়াজ চৌধুরী বলেন, ১০ থেকে ১২ বছর আগেও গভীর সমুদ্র থেকে দল বেঁধে এই সৈকতে এসে ডিম পাড়ত হক্সবিল, গ্রিন টার্টল ও অলিভ রিডলে— এই তিন প্রজাতির কাছিম। কয়েক বছর ধরে হক্সবিল ও গ্রিন টার্টল আর ডিম পাড়তে আসছে না। দুই বছর ধরে অলিভ রিডলের ডিম পাড়তে আসার সংখ্যাও কমে যাচ্ছে।
মেরিন বায়োলজিস্ট আবদুল কাইয়ুম বলেন, নির্জন সৈকতে কচ্ছপ ডিম দিতে আসে। নানা কারণে ডিম দেওয়ার স্থানগুলো ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠেছে। পর্যটনের বিকাশের সঙ্গে সঙ্গে অপরিকল্পিত অবকাঠামো উন্নয়নের পাশাপাশি সৈকতে আলোকসজ্জা, সমুদ্রে পরিত্যক্ত জাল ফেলে দেওয়া, ডিম ছাড়ার মৌসুমে বিচ ডাইভিং, খেলাধুলা, সৈকতে হাঁটা ইত্যাদি কচ্ছপের ডিম দেওয়ার পরিবেশ নষ্ট করছে।
আমারবাঙলা/এমআরইউ