কক্সবাজারের সাগরদ্বীপ কুতুবদিয়া। এর আলী আকবরডেইল ইউনিয়নের সমুদ্রতীরবর্তী গ্রাম তাবলেরচর। এ গ্রামে সাত হাজার মানুষের বসবাস। গ্রামের মধ্যভাগে আছে ১০৭ বছরের পুরোনো একটি পুকুর। ‘ছৈয়দার বাবার পুকুর’ নামের এ জলাশয়ের ৩০০ গজ পশ্চিমে আছে একটি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়। গত ছয় বছরে এই পুকুরে ডুবেই ১১ শিশুর মৃত্যু হয়েছে।
কেবল ‘ছৈয়দার বাবার পুকুর’ নয়, কুতুবদিয়ার অনেক পুকুরে এমন দুর্ঘটনা ঘটছে। পুকুরে ডুবে শিশুমৃত্যু রোধ করা যাচ্ছে না কিছুতেই। উপজেলার ছয় ইউনিয়নে পুকুর আছে ১০ হাজারের বেশি। ৯৫ শতাংশই পরিত্যক্ত। ঘেরা-বেড়াবিহীন এসব পুকুরই শিশুদের জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে। উপকূলের এই উপজেলায় মাটির অভাব পূরণে ও লবণ মজুত করতে খোঁড়া হয় গর্ত। সেসব গর্তে পানি জমে পুকুরের আকার ধারণ করে। আবার মাটি দুষ্প্রাপ্য বলে পুকুরগুলো ভরাটও করা যাচ্ছে না।
উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স সূত্রে জানা যায়, চলতি বছরের ১০ মাসে পুকুরে ডুবে মারা গেছে ৩৭ জন শিশু। আগের ছয় বছরে মারা গেছে আরো ২৯৪ জন। সাত বছরে সব মিলিয়ে মারা গেছে ৩৩২ শিশু। এদের ৯০ ভাগের মৃত্যু হয়েছে বাড়ির পাশের পুকুরে ডুবে। পাঁচ ভাগের মৃত্যু লবণ মজুতের গর্ত পড়ে। নিহত শিশুদের ৭৫ ভাগের বয়স পাঁচ বছরের কম।
সম্প্রতি কুতুবদিয়ার ছয়টি ইউনিয়নের অন্তত ৪৫টি গ্রাম ঘুরে দেখা গেছে, ঘরে ঘরে পরিত্যক্ত পুকুর। একটি বাড়ির সামনে চারটি পুকুরও দেখা গেছে। লবণ মাঠেও কয়েকশ বড় আকৃতির গর্ত দেখা গেছে। মাঠে উৎপাদিত লবণ গর্তে মজুত করেন চাষিরা।
উপজেলা প্রশাসন, জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদফতর ও হাসপাতাল সূত্রে জানা গেছে, ৯৯ দশমিক ৩২ বর্গকিলোমিটার আয়তনের এই উপজেলার লোকসংখ্যা এক লাখ ৫৭ হাজার। পরিবারের সংখ্যা ১৯ হাজর ৯০৫। পুকুর আছে ১০ হাজারের বেশি। এর মধ্যে ৯০ শতাংশ পরিত্যক্ত এবং অরক্ষিত।
উপজেলার আলী আকবরডেইল ইউনিয়নের তাবলেরচর গ্রামের ‘ছৈয়দার বাবার’ পুকুরে কাছাকাছি পাঁচটি গ্রামের অবস্থান।
সরেজমিন দেখা গেছে, বাড়ি থেকে শিশুরা বিদ্যালয়ে আসা-যাওয়া করে ওই পুকুরের দুই পাশের রাস্তা দিয়ে। বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক জালাল আহমদ বলেন, শতবর্ষী এই পুকুরে ডুবে গত ছয় বছরে অন্তত ১১ জন শিশুর মৃত্যু হয়েছে। এলাকাবাসীর দাবির প্রেক্ষিতে গত ১০ নভেম্বর পুকুরের দুই পাশে বাঁশের বেড়া দিয়েছে বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা কোস্ট ফাউন্ডেশন।
গত ১১ অক্টোবর সকালে এই পুকুরে ডুবে মারা গেছে বিদ্যালয়ের দ্বিতীয় শ্রেণিপড়ুয়া ছাত্র আশরাফুল হোসেন (৭)। সে তাবলেরচরের জেলে মো. হোসেনের ছেলে। আশরাফুল সাঁতার জানে না জানিয়ে তার বাবা মো. হোসেন বলেন, বাড়ি থেকে বিদ্যালয়ে যাওয়ার পথে আশরাফুল কীভাবে পুকুরে পড়ে গেল জানা গেল না।
পুকুরের উত্তর পাশে কৃষক আবু মুছার বাড়ি। চার বছর আগে বাড়ির উঠানে খেলতে গিয়ে পুকুরে ডুবে মারা গেছে মুছার ছেলে কালু (৫) এবং আড়াই বছর আগে মারা গেছে মেয়ে কাকলী (৩)। আবু মুছা (৫২) বলেন, বাড়িতে নলকূপ আছে, তাতে পানি ওঠে না, বাধ্য হয়ে পুকুরে যেতে হয়। তার মূল্য দিতে হয়েছে। ছেলের পর মেয়েকে কেড়ে নিল পুকুর।
তিন বছর আগে পুকুরে ডুবে মারা গেছে একই গ্রামের কৃষক ফরিদুল আলমের ছেলে শাহী আদনান (৫)। মা হাসিনা আক্তার বলেন, সকালে রান্নার সময় আদনান উঠানে খেলতে যায়। কিছুক্ষণ পর দেখেন পানিতে ছেলের লাশ ভাসছে।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, গত ছয় বছরে এই পুকুরে ডুবে আরো সাতজন শিশু মারা গেছে। তারা হলো স্থানীয় আবুল হোসেনের ছেলে আবদুল করিম (৬), করিম দাদের ছেলে হোসাইন (৪), আবু তাহেরের মেয়ে জোবাঈদা (৩), কামাল উদ্দিনের মেয়ে ছামিয়া (২), আবদুস শুক্কুরের মেয়ে পুতুনী (৪), ছৈয়দ নুরের ছেলে জাহেদুল ইসলাম (৫) ও আবুল কালামের মেয়ে ঝিনু আরা (৪)।
তাবলেরচরে পুকুরে ডুবে শিশুমৃত্যু রোধ এবং জনসচেতনতামূলক কর্মকাণ্ড পরিচালনা করেন কোস্ট ফাউন্ডেশনের ফিল্ড ফ্যাসিলিটেটর শাহানা আক্তার। তিনি বলেন, এই গ্রামের মানুষ পুকুরের পানির ওপর নির্ভরশীল। ১০ নভেম্বর অতি ঝুঁকিপূর্ণ পুকুরটিতে বাঁশের ঘেরা দেওয়ায় পরিস্থিতির উন্নতি হয়েছে। এরপর আর কোনো শিশুর মৃত্যু হয়নি।
উপজেলার ১৭ কিলোমিটার দীর্ঘ আ জ ম সড়কের (প্রধান সড়ক) দুই পাশে রয়েছে কয়েক হাজার পুকুর। সেখানে গিয়ে দেখা গেল শিশুরা পুকুরপাড়ে খেলাধুলা করছে। কেউ কেউ পুকুরে নেমে গোসলও করছে। তাদের বাধা দেওয়ার কেউ নেই।
কুতুবদিয়ায় পুকুরে ডুবে শিশুর মৃত্যুর কারণ উদ্ঘাটনে ২০২২ সালের জুলাই মাসে গবেষণা তথ্য সংগ্রহ করে কোস্ট ফাউন্ডেশনের একদল কর্মী। পুকুরে ডুবে নিহত শিশুর তথ্য সংগ্রহের পাশাপাশি ১৪৫ জন অভিভাবকের (নিহত শিশুর মা–বাবা) সাক্ষাৎকার নেওয়া হয়। ২০২৩ সালে জুলাইতে প্রকাশিত গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়, পুকুরে ডুবে মারা যাওয়া শিশুদের ৭৫ ভাগের বয়স ছিল পাঁচ বছরের কম। ১৬ ভাগের বয়স ছয়-সাত বছর। নয় ভাগের বয়স আট বছর। ৯৯ ভাগ শিশুর সাঁতার জানা ছিল না।
শিশুমৃত্যু রোধে করণীয় বিষয়ে জানতে চাইলে কোস্ট ফাউন্ডেশনের প্রধান নির্বাহী রেজাউল করিম চৌধুরী বলেন, শিশুদের চোখে চোখে রাখো জরুরি। পাশাপাশি পরিত্যক্ত পুকুরের চার দিকে পুরোনো জাল দিয়ে ঘিরে রাখা, পুকুরঘাটে তিন ফুট উঁচু করে পকেট দরজা রাখার উদ্যোগ নিতে হবে। একই সঙ্গে পাঁচ বছরের বেশি বয়সী শিশুদের সাঁতার শেখানো, কমিউনিটি সচেতনতা তৈরির ওপর জোর দিতে হবে।
পুকুরে ডুবে শিশুর মৃত্যু রোধে গত ১ আগস্ট থেকে কুতুবদিয়ায় বিশেষ প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়েছে বলে জানান কোস্ট ফাউন্ডেশনের কক্সবাজারের ঊর্ধ্বতন সমন্বয়কারী জিয়াউল করিম চৌধুরী। তিনি বলেন, এক বছর মেয়াদি প্রকল্পের আওতায় ছয়টি ইউনিয়নের ১০০টি ঝুঁকিপূর্ণ পুকুর চিহ্নিত করা হয়েছে, যেখানে শিশুমৃত্যুর ঘটনা বেশি। ইতোমধ্যে ১০টি পুকুরে বাঁশের ঘেরা দেওয়া হয়েছে। আগামী ডিসেম্বরের মধ্যে আরো ৪০টি পুকুরে ঘেরা দেওয়া হবে।
উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা গোলাম মোস্তফা বলেন, হাসপাতালের উদ্যোগে সম্প্রতি নিহত শিশু পরিবারের ওপর জরিপ চালিয়ে দেখা গেছে, সকাল ৯টা থেকে দুপুর ১২টার মধ্যে পুকুরে ডুবে বেশির ভাগ শিশুর মৃত্যু হয়েছে। ওই সময় পুরুষেরা কাজের সন্ধানে বাইরে থাকেন। মায়েরা রান্নাবান্নার কাজে ব্যস্ত থাকেন ঘরের ভেতরে।
তিনি বলেন, পুকুরে ডোবা শিশুকে পানি থেকে তুলে মাথায় নিয়ে ঘোরানো, পেটে চাপ দিয়ে পানি বের করা, ছাই বা লবণ দিয়ে শিশুর শরীর ঢেকে দেওয়া অথবা বমি করানোর চেষ্টা চালানো হয়। এসব করতে গিয়ে সময় নষ্ট হয়। হাসপাতালে পৌঁছাতে দেরি হয়। পুকুর থেকে উদ্ধারের পর শিশুকে সঙ্গে সঙ্গে হাসপাতালে নিয়ে আসার পরামর্শ দেন তিনি।
আমারবাঙলা/এমআরইউ