ফুটবল ঈশ্বর বলা হয় ডিয়েগো ম্যারাডোনাকে। ফের্নান্দো সিগনরিনি সেভিয়ায় ম্যারাডোনার ফিজিক্যাল ট্রেইনার ছিলেন। তিনি একটি বই লিখেছেন- ‘ডিয়েগো দেসদে আদেন্ত্রো’নামে।
১৯৯৩ সালের জুনে ম্যারাডোনার সেভিয়া ছেড়ে আর্জেন্টিনায় ফেরার নেপথ্যে ঠিক কী ঘটেছিল, সেটি ওই বইয়ে জানিয়েছেন সিগনরিনি।
একটি ম্যাচে হাঁটুতে তিনটি ইনজেকশন নিয়ে মাঠে নামার ১০ মিনিট পর তাকে তুলে নিয়েছিলেন সেভিয়া কোচ কার্লোস বিলার্দো। ভীষণ খেপেছিলেন ম্যারাডোনা। ’৮৬ বিশ্বকাপ জিতেছিলেন যার হাত ধরে, সেই বিলার্দোকে যা নয় তাই বলে রাগে গজরাতে গজরাতে মাঠে ছাড়েন ম্যারাডোনা। পরে ওসব শুনে সে রাতেই ম্যারাডোনার বাসায় গিয়ে হাজির বিলার্দো। ভীষণ তর্কাতর্কির যবনিকতাপাত ঘটেছিল একটি ঘুষিতে।
সিগনরিনির ভাষায়, উপরতলায় গিয়ে দেখেন ম্যারাডোনা একটি চেয়ারে বসে আছেন আর বিলার্দো দেয়ালে ঠেস দিয়ে নিচে বসে। বিস্ময় ও রাগে কোচের চোখ দুটো যেন বের হয়ে আসবে! সিগনরিনি যা বোঝার বুঝে নিয়েছিলেন। পরে ম্যারাডোনাই নাকি তাকে বলেছিলেন, একটি ঘুষিতেই সব সমস্যা মিটিয়ে ফেলেন। সেই সপ্তাহেই স্প্যানিশ ক্লাবটির সঙ্গে ছাড়াছাড়ি হয়ে যায় ম্যারাডোনার।
সর্বকালের অন্যতম সেরা ফুটবলার ম্যারাডোনার ক্যারিয়ার মোটামুটি সবারই জানা। সেভিয়া ছেড়ে আর্জেন্টিনায় ফিরে নিওয়েলস ওল্ড বয়েজে যোগ দেন প্রয়াত আর্জেন্টাইন কিংবদন্তি। হ্যাঁ, মেসির ছোটবেলার ক্লাবও এই নিওয়েলস। সেই ক্লাবে পাঁচ ম্যাচ খেলার পর ম্যারাডোনা ফিরেছিলেন তার প্রাণের ক্লাব বোকা জুনিয়র্সে। দুই বছর সেখানে খেলে তুলে রাখেন বুট। আর্জেন্টিনা অনূর্ধ্ব–২০ এবং আর্জেন্টিনা জাতীয় দলের বাইরে ম্যারাডোনার খেলা ক্লাবগুলো সময়ক্রম অনুসারে এমন—আর্জেন্টিনোস জুনিয়র্স, বোকা জুনিয়র্স, বার্সেলোনা, নাপোলি, সেভিয়া, নিওয়েলস ওল্ড বয়েজ ও বোকা জুনিয়র্স।
জানেন কি ম্যারাডোনা সেভিয়া থেকে জন্মভূমিতে ফেরার পর তার ক্যারিয়ারের গতিপথ অন্যদিকেও মোড় নিতে পারত? মানে, আর্জেন্টিনায় ফেরার পর তার প্রথম ক্লাব নিওয়েলস ওল্ড বয়েজ নয়, অন্য একটি ক্লাবও হতে পারত। সেটি আবার পোপ ফ্রান্সিসের প্রিয় ক্লাব। ঠিকই ধরেছেন, পোপ ফ্রান্সিস ক্লাবটির সমর্থক—সেটি ২০১৩ সালে জানাজানি হওয়ার পর আন্তর্জাতিক পরিচিতি পেয়ে গিয়েছিল ক্লাবটি। সান লরেঞ্জো দে আলমাগ্রো।
ঘটনাটি একবার আর্জেন্টিনার সংবাদমাধ্যম টিওয়াইসি স্পোর্টসকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে নিজেই জানিয়েছিলেন ম্যারাডোনা। শুরুটা ছিল এমন, ম্যারাডোনা আর্জেন্টিনায় ফেরার পর বুয়েনস এইরেসে তার অ্যাভিনিউ লিবার্তাদোরের বাসায় সান লরেঞ্জোর তখনকার সভাপতি ফের্নান্দো মিয়েলেকে নিয়ে গিয়েছিলেন ক্লাবটির কোচ হেক্টর ‘ব্যাম্বিনো’ ভেইরা। ৭৮ বছর বয়সী এ কোচের আর্জেন্টাইন ফুটবলে খ্যাতি অনেক। কোচ হিসেবে ঘরোয়া ফুটবলে যেমন সফল, তেমনি খেলোয়াড় হিসেবে ১৯৬৮ সালে সান লরেঞ্জোকে মেত্রোপলিতানো চ্যাম্পিয়নশিপ জিতিয়েছিলেন। আর্জেন্টাইন ফুটবলে পেশাদার যুগ শুরুর পর প্রথম অপরাজিত শিরোপা জয়ের সেটিই প্রথম ঘটনা। ম্যারাডোনার বাসায় গিয়ে তাকে আনুষ্ঠানিকভাবে সান লরেঞ্জোয় যোগ দেওয়ার প্রস্তাব দিয়েছিলেন মিইলে ও ভেইরা।
২০০৬ সালে টিওয়াইসি স্পোর্টসকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে ঘটনাটা শুনুন ম্যারাডোনার মুখেই, ‘ব্যাম্বিনো এসে জানতে চাইল আমি সান লরেঞ্জোর হয়ে খেলতে চাই কিনা? বললাম, হ্যাঁ, আমি তার সঙ্গে যে কোনো দলে খেলতে পারি।’
ম্যারাডোনা সেই সাক্ষাৎকারেই জানিয়েছিলেন, রসুই ঘরে ম্যারাডোনা তার স্ত্রী ক্লদিও ভিল্লাফানে এবং ভেইরা মিলে কফি খেতে খেতে আড্ডা দিচ্ছিলেন। তখন অন্য ঘরে মিয়েলে এবং ম্যারাডোনার এজেন্ট মার্কোস ফ্রাঞ্চি মিলে চুক্তিপত্র তৈরি করছিলেন। দুই পক্ষ সমঝোতায়ও পৌঁছে গিয়েছিল। ম্যারাডোনার ভাষায়, ‘ভোর চারটার সময় আমি সান লরেঞ্জোর খেলোয়াড়।’
সান লরেঞ্জোর খেলোয়াড় হিসেবেই ঘুমোতে গিয়েছিলেন ’৮৬ বিশ্বকাপ কিংবদন্তি। কিন্তু কয়েক ঘণ্টা পর ঘুম থেকে উঠে সান লরেঞ্জো সভাপতির বাসায় যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন ম্যারাডোনা। চুক্তিতে সই করতে হবে। ঠিক তখনই তার এজেন্ট ফ্রান্সিসের ফোন। ম্যারাডোনার ভাষায়, ফ্রান্সিস তাকে ফোন করে বলেছিলেন, ‘মিয়েলে চুক্তিপত্রে বেশ কিছু শর্ত পাল্টেছেন, যেগুলো তুমি বলেছিলে সেগুলো কার্যকর হয়নি।’
ম্যারাডোনার ভাষায়, ‘সমস্যাটা আর্থিক ছিল না’ বরং তিনি চেয়েছিলেন ভেইরাই যেন সান লরেঞ্জোর কোচ হিসেবে চালিয়ে যান।
এরপর ম্যারাডোনা আর সেই চুক্তিপত্রে সই করেননি। তাই সান লরেঞ্জোর সমর্থকেরাও তাকে নিজেদের করে পায়নি। যদিও ‘সাইক্লোন’ সমর্থকদের কাছে ম্যারাডোনার জনপ্রিয়তা আজও ঈর্ষণীয়। পরে সে বছরের ১৩ সেপ্টেম্বর নিওয়েলসে যোগ দেন ম্যারাডোনা।
সেবার চতুর্থ মেয়াদে সান লরেঞ্জো কোচের দায়িত্ব পালন করা ভেইরা ১৯৯৬ সাল পর্যন্ত ক্লাবটিতে ছিলেন। ক্লাবটি ছেড়ে কোথায় যোগ দিয়েছিলেন জানেন? ম্যারাডোনা তখন যেখানে ছিলেন সেখানে। বোকা জুনিয়র্স!
আমারবাঙলা/এমআরইউ