এম এম রুহুল আমীন: ‘অমর একুশ’ বাঙালি জাতির একটি অবিস্মরণীয় অধ্যায়। ভাষা আন্দোলনকে কেন্দ্র করে একটি জাতি রাষ্ট্রের জন্ম হতে পারে তা বাংলাদেশ প্রমাণ করেছে। ১৯৪৭ সালের ঢাকা সম্মেলনে বাংলা ভাষা সম্পর্কিত প্রথম প্রস্তাব উত্থাপিত হয়। ১৯৪৮ সালের জানুয়ারিতে গাজিউল হক ও শেখ মুজিবুর রহমান পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা বাংলা করার জন্য লিফলেট বিতরণ করা শুরু করেন। একই বছরের মার্চ মাসে পূর্ব বাংলার মুখ্যমন্ত্রী খাজা নাজিমুদ্দিনের সাথে আট দফার একটি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয় এবং বাংলা ভাষা এখানকার শিক্ষার মাধ্যম হিসেবে স্বীকৃতি লাভ করে। এরপর অনেক চড়াই উৎরাই পেরিয়ে এক রক্তক্ষয়ী আন্দোলনের মাধ্যমে ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি ’বাংল’ রাষ্ট্রভাষা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়। বাংলা ভাষার আন্দোলনই প্রকৃতপক্ষে বাংলাদেশের স্বাধীনতার পথ খুলে দেয়। ১৯৭২ সালের ১৬ ডিসেম্বর বাংলাদেশের প্রথম সংবিধান ’বাংলা’ ভাষায় লিপিবদ্ধ করা হয়।
১৯৭৫ সালের ১২ মার্চ বঙ্গবন্ধু অফিসের কাজে বাংলা ভাষা ব্যবহারের প্রজ্ঞাপন জারি করেন। রাষ্ট্রের সর্বস্তরে বাংলা ভাষার দাবি আপামর জনসাধারণের। পৃথিবীর বহু দেশে ভাষার জন্য আন্দোলন হয়েছে কিন্তু বাংলাদেশের মত এত প্রবল আন্দোলন আর কোথাও দেখা যায়নি। মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া, ফিলিপাইন, আজারবাইজান প্রভৃতি দেশেও ভাষার জন্য আন্দোলন হয়েছে। তবে তারা তাদের নিজস্ব ভাষা পেলেও নিজস্ব বর্ণমালা পায়নি। উল্লেখ্য দেশগুলোতে ইংরেজি বর্ণমালা দিয়ে তাদের ভাষা চর্চা করতে দেখা যায়। বাংলা ভাষাকে ও তদ্রুপ উর্দু বর্ণমালার মাধ্যমে চালু করারও প্রস্তাব আসে। কিন্তু বাঙালি একমাত্র জাতি যারা ভাষার জন্য বর্ণমালাও নিজস্ব করে রাখতে সক্ষম হয়েছে।
বাংলাদেশের আজকের প্রেক্ষাপট এবং বাংলা ভাষা আন্দোলনের প্রেক্ষাপট এক নয়। যে মহৎ স্বপ্ন নিয়ে বাঙালি জাতি ভাষা আন্দোলন ও স্বাধীনতা সংগ্রামে ঝাপিয়ে পড়েছিল সেই স্বপ্ন বাস্তবিকার্থেই স্বপ্নই রয়ে গেছে। নিজস্ব ভাষার মাধ্যমে বহু জাতি সমৃদ্ধির উচ্চ শিখরে উঠতে সক্ষম হয়েছে। পৃথিবীর বহু দেশ ভিনদেশী বইপত্র নিজস্ব ভাষায় অনুবাদ করে জ্ঞান-বিজ্ঞানে প্রভৃত উন্নতি সাধন করতে সক্ষম হয়েছে। কিন্তু বাংলাদেশ সেই স্বপ্ন পূরণ করতে পারেনি।
কবিগুরুর কতিপয় উক্তি আজকের দিনে খুবই প্রাসঙ্গিক: ‘বঙ্গভাষা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাষা নহে, সম্মানলাভের ভাষা নহে, অর্থোপার্জনের ভাষা নহে, কেবলমাত্র মাতৃভাষা। যাঁহাদের হৃদয়ে ইহার প্রতি একান্ত অনুরাগ ও অটল ভরসা আছে তাঁহাদেরই ভাষা। যাঁহারা উপেক্ষাভরে দূরে থাকেন তাঁহারা বাংলা ভাষার প্রকৃত পরিচয় লাভ করিতে কোনো সুযোগই পান নাই। তাঁহারা তর্জমা করিয়া বাংলা বিচার করেন। অতএব সভয়ে নিবেদন করিতেছি এরূপস্থলে তাঁহাদের মতের অধিক মূল্য নাই।
যাঁহারা অনেক ইংরাজি কেতাব পড়িয়াছেন তাঁহারা অনেকেই বাংলা লেখা ও লেখকদের প্রতি কৃপাকটাক্ষ নিক্ষেপ করিয়া থাকেন। এইরূপ অবজ্ঞা প্রকাশ করিয়া তাঁহারা অনেকটা আত্মপ্রসাদ লাভ করেন। বোধ করি ইতর-সাধারণ হইতে আপনাকে স্বতন্ত্র করিয়া লইয়া অভিমানে তাঁহারা আপাদমস্তক কণ্টকিত হইয়া উঠেন। একটা কথা ভুলিয়া যান যে, পৃথিবীতে বড় হওয়া শক্ত, কিন্তু আপনাকে বড় মনে করা সকলের চেয়ে সহজ।
এখনো বাংলাদেশের অনেক দপ্তরে বাংলা ভাষার ব্যবহার হয় না। দেশের ব্যবসা প্রতিষ্ঠান, সাইনবোর্ড, বিচারালয়ের কাজে এখনো ইংরেজির ছাপ প্রকট। ভিন্ন ভাষা শিখতে গিয়ে শিক্ষার্থীরা মূল লেখাপড়া ও গবেষণার পিছিয়ে আছে। বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয় সমূহে অনুবাদ গ্রন্থের সংখ্যাও উল্লেখযোগ্য হারে বাড়ে নাই। বাংলাদেশের আজকের বাস্তবতা হলো শুধুমাত্র উচ্চতর গবেষণা ও বৈদেশিক যোগাযোগ ছাড়া আভ্যন্তরীণ সকল ক্ষেত্রে একমাত্র যোগাযোগ বাংলা ভাষায় হওয়া অপরিহার্য। তা না হলে এই দেশের সামগ্রিক অগ্রগতি স্বপ্নই হয়ে থাকবে।
অমর একুশের চেতনা হোক সর্বস্তরে বাংলা ভাষার শক্তিশালী প্রচলন।
এবি/এইচএন